শোকে বিহ্বল মা।
স্তম্ভিত আত্মীয়-পরিজন। ক্ষিপ্ত পাড়া-পড়শিরা।
হাতির পায়ের নীচে সন্তান হারিয়েও দিলীপ সাহনি কিন্তু জনতার কাছে আর্জি জানালেন, “হাতিটাকে মারবেন না!”
অনেকেরই হাতে তখন ঢিল, পাটকেল। পুলিশের কর্ডন ভেঙে বারবার হাতির দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কয়েক জন। হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করেও মৃত ছেলে নিয়ে যাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে, বর্ধমান শহরের আনজিরবাগানের সেই দিলীপবাবু তাঁদের বললেন, “হাতিটা প্রায়ই এলাকায় আসে। কোনও দিন গোলমাল করেনি। ওকে কেউ কিছু করবেন না।” |
মঙ্গলবার বেলা ১২টা নাগাদ বেনারসের ‘আনারকলি’ যখন আনজির বাগানের মাটিবাগ পাড়ায় ঢুকেছিল, তখনও কেউ ভাবতে পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে। হাতির পিঠে বসেছিলেন তরুণ মাহুত অনিল দুবে আর তাঁর মাঝবয়সী সঙ্গী দারোগাদাস মিশ্র। বাচ্চাকাচ্চারা হাতির পিঠে উঠে দু’জনের মাঝে বসছিল। তার পরে নেমে পয়সা গুঁজে দিচ্ছিল হাতির শুঁড়ে। মেজোছেলে, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া বিবেককে হাতির পিঠে চড়িয়েছিলেন দিলীপবাবুও। সে নেমে পয়সা দিতে যেতেই ঘটে যায় ভয়ঙ্কর ঘটনা। বছর আটেকের ছেলেটির হাত পেঁচিয়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দেয় হাতিটি। মাথার উপরে চাপিয়ে দেয় পা।
বিবেকের দাদা ঋত্বিক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বোন নন্দিনী অনেক ছোট, এখনও স্কুলে যায় না। কী ঘটেছে তা ঋত্বিক কিছুটা বুঝলেও, নন্দিনী কিছুই বুঝছে না। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া ইস্তক বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন মুন্নি সাহনি। পাড়া-পড়শি তাঁকে ঘিরে রেখেছেন, সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু অনেকেরই মুখে কথা জোগাচ্ছে না।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিন্দিয়া সাউয়ের মনে পড়ে, “সকালে হাতিটা এসেছিল। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছিল। বাচ্চারাও পিছন-পিছন ঘুরছল। অনেকে পিঠেও চাপছিল। বিবেককের ওর বাবাই হাতির পিঠে চাপায়। পিঠ থেকে নেমে ও হাতির শুঁড়ে পয়সা দিতে গেল। তখনই...” কথা শেষ করতে পারেন না তিনি। ওই এলাকারই রাজকুমার সাউ বলেন, “আমরা হাতিকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করি। খাতির-যত্নের লোভে আমাদের এখানে প্রায়ই হাতি নিয়ে আসে মাহুতেরা। কিন্তু হাতি রেগে গিয়ে বাচ্চাকে পিষে মারছে, এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। হাতিটা পাগল কি না, পরীক্ষা করে দেখা দরকার।”
হামলার সময়ে হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমেও বিবেককে রক্ষা করতে পারেননি মাহুত। কিন্তু তা বলে হাতিটি ‘পাগল’, এমন অভিযোগ তিনি বা তাঁর সঙ্গী মানতে নারাজ। দারোগাদাস বলেন, “আমরা এসেছি বারাণসীর ভাদৌ থেকে। এক মাত্র গ্রীষ্ম বাদে সারা বছরই আমরা রাজ্যে-রাজ্যে ঘুরি। আনারকলি বরাবরই খুব ঠান্ডা স্বভাবের। কেন ও আচমকা খেপে গেল, সেটা বোঝা দরকার।” মাহুতের বক্তব্য, “গত পাঁচ বছর ধরে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। মানুষকে হাতি দেখিয়ে আনন্দ দিচ্ছি। কখনও এমন ঘটেনি। গত কয়েক দিন ধরে আমরা বর্ধমানে ঘুরছিলাম। হাতি খুশিই ছিল। কিন্তু এ দিন কিছু ছেলেছোকরা হাতিকে উত্ত্যক্ত করছিল। ঢিল মারছিল। কেউ আবার লেজ মুচড়ে ধরেছে। এই তাতেই ওর মেজাজ বিগড়ে যায়। ও মোটেই পাগল নয়।” |
কিন্তু দুর্ঘটনার কথা শুনে যাঁরা ছুটে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এ সব শুনতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের দাবি, মাহুতকে গ্রেফতার করতে হবে এবং মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তত ক্ষণে পুলিশের উপস্থিতিতে হাতির সামনের দু’পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছেন মাহুতেরা। পুলিশি ঘেরাটোপে নির্বিকার ভঙ্গীতে সে সামনে রাখা ডালপালা, কলাগাছ চিবিয়ে চলেছে। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনতার একাংশ ঢিল-পাথর নিয়ে বারবার তেড়ে যেতে থাকে। আবার হাতিটি শিকল পরা অবস্থাতেও একটু সামনে এগোলে পড়িমরি করে পিছু হটতে থাকেন সকলে।
এই সময়েই হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলে ফিরে আসেন দিলীপবাবু। তিনি লোকজনকে বলতে থাকেন, “আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য হাতিটাকে দায়ী করা ঠিক হবে না। যা ঘটেছে, তা আমার কপালের দোষে। হাতিটাকে মেরে লাভ নেই।” সকলেই যে তাঁর এই কথায় কান দিয়েছে, তা নয়। কিন্তু পুলিশের কর্ডন ভেঙে বেশি দূর এগোতেও পারেনি। এই পরিস্থিতিতে হাতিটিকে নিরাপদ হেফাজতে নেওয়ার ব্যাপারে বন দফতরের ‘সহযোগিতা’ চেয়েও লাভ হয়নি বলে পুলিশের অভিযোগ। খোদ জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনাও বিভাগীয় বনাধিকারিক গোপালচন্দ্র কাজুরির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বলে অভিযোগ।
জেলাশাসকের আক্ষেপ, “উনি আমার ফোনও ধরেননি। ওঁর বাংলোয় লোক পাঠিয়ে আমি ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। পুলিশকে বলেছি, আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে।” সহ-বনাধিকারিক প্রশান্তকুমার রায় আবার বলেন, “আমি বাইরে রয়েছি। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।” শেষমেশ মরিয়া হয়ে বর্ধমান থানার আইসি স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, দামোদরের তীরে সদরঘাটে তাঁরা হাতিটিকে রাখবেন বলে মনস্থ করেছেন। তাঁদের নির্দেশে মাহুত হাতিটিকে সরিয়ে নিয়ে চলে যান (পরে অবশ্য মামলা রুজু করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে)।
শোক বুকে নিয়ে পিছনে পড়ে থাকে আনজির বাগান।
আর সন্তানহারা এক দম্পতি।
|