২০০৯ সালের কথা। দীর্ঘ আবেদন-নিবেদনে ফল না মেলায় অনশনে বসেন কিছু মানুষ। দাবি পূরণ হয়েছিল সে বার। পাড়ায় বিদ্যুৎ আসে।
ওই বছরেই আর এক দফা অনশনের জেরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পাওয়া গিয়েছে।
আরামবাগের সালেপুর ১ পঞ্চায়েতের সালেপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ার মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, দরখাস্ত করে, স্মারকলিপি জমা দিয়ে, প্রশাসনের দরজায় দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে কোনও কাজ হওয়ার নয়। দাবি মেটাতে অনশন করতে হবে। কখনও বা ভোট বয়কট। তাতে যদি কিছু সুরাহা হয়। গ্রামের সার্বিক উন্নতির দাবিতে ক’দিন আগেও আর এক দফা অনশন করেছেন গ্রামের কিছু মানুষ। তাঁদেরই এক জন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শম্পা ঘোড়ুই বলেন, “আমাদের গ্রামটি দ্বারকেশ্বর নদীবাঁধের ভিতরে। বন্যা কবলিত এলাকা। রাস্তাঘাট ভেঙে যাতায়াতের উপযোগী নেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনও ব্যবস্থা নেই। পানীয় জলের সমস্যা আছে। জমিতে সেচের ব্যবস্থাও নেই। এ সব প্রতিকারের জন্য দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে আবেদন-নিবেদন চলেছে। কাজ হয়নি। অগত্যা ফের অনশন।” প্রশাসনের আশ্বাসে অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। কিন্তু সরকারি আশ্বাস আর গ্রামের মানুষের মনে ভরসা জাগায় না।
আরামবাগের বিধায়ক তৃণমূলের কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা বলেন, “অনশন, বয়কট কোনও উপায় হতে পারে না। ওঁরা আমাদের কাছে দাবি পেশ করুন। নতুন সরকার সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছে। সব দাবি ধাপে ধাপে ঠিকই পূরণ হবে।”
প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, পাড়াটির ভৌগলিক অবস্থান যত সমস্যার মূলে। দ্বারকেশ্বর নদীর গা-ঘেঁষে এই পাড়ার আয়তন প্রায় বারোশো বিঘা। শ’আটেক মানুষের বাস। প্রায় প্রতি বর্ষার সময়েই কার্যত দ্বীপের আকার নেয় এই পাড়া। রাস্তার মোরাম ফি-বছর ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় জলের তোড়ে।
উন্নয়নের দাবিতে পাড়ার মানুষ এককাট্টা। রাজনীতির রঙ লাগেনি তাতে। তাঁদের নেতৃত্বে থাকা সুশীলকুমার জানা বলেন, “তহবিলের অভাবের বাহানা দিয়ে কোনও উন্নয়নই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়নি। অনশনে বসলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। মাটি বিক্রির অসাধু ব্যবসা রুখতেও অনশন করে কাজ হয়েছে। ভোট বয়কটের ডাক দিলে রাস্তা সারাইয়ের কাজ তবু কিছু কিছু হয়।” পাড়ার বাসিন্দাদের মূল দাবি, বাঁধের উপর থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটি পাকাপোক্ত করে তৈরি করা হোক। এখন এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে মোরামের রাস্তায় পৌঁছতে হয়।
স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-অফিস-দোকানপাট সর্বত্র যেতে ব্যবহার করতে এই রাস্তা। সেটির হাল না ফিরলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির একশেষ। আরও সমস্যা হল, বর্ষায় জল জমেও ফসল নষ্ট হয়। গ্রীষ্মে সেচের অভাবে আবার চাষের সমস্যায় ভোগেন মানুষ। একটি রিভার পাম্পের দাবি দীর্ঘ দিনের। পাড়ায় প্রাথমিক স্কুল নেই। শিশুশিক্ষা কেন্দ্র নেই। গত পঞ্চাশ বছরে অন্তত আড়াইশো বিঘা জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। পাড়ার বাসিন্দা জয়গুরু সামন্ত, অর্চনা জানা, দিলীপ শাসমল, রামকৃষ্ণ কুণ্ডুদের বক্তব্য, পাড়া-সংলগ্ন দ্বারকেশ্বরের উত্তর ও পশ্চিম পাড়ে বোল্ডার ফেলে ভাঙন রোধ করা সম্ভব। তা হলে সমস্যার একটা বড় অংশ মিটবে।
সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন সালেপুর ১ পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিআইয়ের তারারানি সিংহ। তিনি বলেন, “পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দাদের আন্দোলন যুক্তিযুক্ত। পাড়ার উন্নয়নে আমরা যে সব পরিকল্পনা করেছি, তা তহবিলের অভাবে কার্যকর করা যায়নি।”
ওই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত আরামবাগ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি সিপিআইয়ের বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়ও সম্প্রতি পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন। তাঁর কথায়, “ওই পাড়ায় পাকাপোক্ত রাস্তা, নদী বাঁধে বোল্ডার ফেলা প্রভৃতি কাজে প্রায় ৫-৭ কোটি টাকা দরকার।” টাকার অভাবেই কাজ হয়নি বলে তাঁর দাবি।
আরামবাগের বিডিও মৃণালকান্তি গুঁই বলেন, “আমরা জেলা থেকে যেমন যেমন টাকা পাই, সেই মতোই কাজ হয়। পাড়াটির দাবি-দাওয়া জেলায় জানানো হয়েছে।” হুগলির অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) সৃষ্টিধর সাঁতরার বক্তব্য, বিষয়টি রাজ্য-স্তরে জানানো হবে। ‘হচ্ছে-হবে’-র এই আশ্বাসেই আপাতত ভরসা রাখতে হচ্ছে পশ্চিমপাড়ার মানুষকে। |