জীবন দিয়ে শিশুর প্রাণ বাঁচালেন নিঃসন্তান মহুয়া
ম হয়ে ছিল রিষড়ার সুভাষনগর নবগ্রামের আচার্যবাড়ি। মাঝেমধ্যে নীরবতা কাটিয়ে শোনা যাচ্ছিল কান্নার রোল। পরিবারের অ্যালবাম হাতে নিয়ে ইন্দ্রাণী আচার্য বললেন, “চোখের সামনে দেখলাম, অয়ন্তিকাকে বাঁচিয়ে আমাদের চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে গেল দিদি।”
দিদি মহুয়া আচার্য নিঃসন্তান ছিলেন। দেওরের দুই মেয়েকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসতেন। ইন্দ্রাণী তাঁর জা। তিনি বললেন, “সেই ভালবাসার যে এই পরিণতি হবে, ভাবিনি। আমার মেয়ে ও শাশুড়িকে বাঁচিয়ে দিদি নিজেই চলে গেল।”
ভালবাসার টানেই বোধহয় চরম বিপদের মুহূর্তেও নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলেছিলেন মহুয়া। একে একে রেল লাইন থেকে তিনি ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন দেওরের নাবালিকা মেয়ে এবং শাশুড়িকে। কিন্তু নিজেকে সরাতে পারেননি। সোমবার রাতে রিষড়া স্টেশনে ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়া মহুয়াদেবীকে স্থানীয় সেবাসদন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। আরও এক শিশু এবং তার পিসেমশাই মারা যান ওই ঘটনায়। গুরুতর জখম হয় শিশুটির ভাই। ওই দুই শিশুকেও বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন মহুয়াদেবী। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাই বলছেন।

মহুয়াদেবী।
সোমবার ছিল রিষড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমী। সন্ধে থেকেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় উপচে পড়েছিল ভিড়। এমনিতেই রিষড়া স্টেশনের টিকিট কাউন্টার সংলগ্ন ৩ নম্বর গেটে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এ দিন রেল লাইনের পূর্ব থেকে পশ্চিমে অথবা পশ্চিম থেকে পূর্বে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার জন্য শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ওই লেভেল ক্রসিং পেরোচ্ছিলেন। লেভেল ক্রসিংয়ের বন্ধ গেটে মাথা গলিয়েও বহু মানুষ পারাপার করছিলেন।
ওই সন্ধ্যায় শাশুড়ি বীণাদেবী, জা ইন্দ্রাণী, জায়ের বছর এগারোর মেয়ে অয়ন্তিকা এবং গৌরী গোস্বামী নামে আরও এক আত্মীয়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলেন বছর চল্লিশের মহুয়াদেবী। রাত ৭ টা ৫০ মিনিট নাগাদ তাঁরা বন্ধ লেভেল ক্রসিং পেরোচ্ছিলেন। সেই সময় ১ নম্বর লাইন দিয়ে গ্যালপিং ডাউন বর্ধমান লোকাল হাওড়ার দিকে আসছিল। ট্রেনটি ঠিক কতটা দূরে রয়েছে, ভিড়ের চাপে তা ঠাওর করতে পারেননি মহুয়াদেবীরা। যখন বুঝতে পারেন, ততক্ষণে তীব্রগতিতে বিপদ সামনে হাজির। সেই অবস্থাতেই যত জনকে পারা যায়, বাঁচানোর চেষ্টা করেন মহুয়াদেবী।
এ দিন শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে মৃতদেহগুলির ময়না-তদন্ত হয়। মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃবধূর উপর কৃতজ্ঞতায় অঝোরে চোখের জল ফেলছিলেন ইন্দ্রাণীদেবীর স্বামী অরূপ আচার্য। বলছিলেন, “মহুয়া নিঃসন্তান। আমার দুই মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসত। পরিবারের আপদে-বিপদে সবার আগে ও-ই ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমার পরিবারটাকে বাঁচিয়ে দিয়ে ও-ই চলে গেল।” এক কোণে চুপচাপ বসেছিলেন মহুয়ার স্বামী অসিত আচার্য। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সৌমেন দাসের চোখেমুখে তখনও ঘোর কাটেনি। তিনি বলেন, “কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখলাম, মহিলা প্রাণপণে সকলকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।” তবে, স্টেশনে ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে’ ট্রেন চলাচলের ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শোক-বিহ্বল মহুয়াদেবীর স্বজনরা।
মৃত শিশুটির নাম সত্যম পাণ্ডা (১১)। সে এবং তার জেঠামশাইয়ের ছেলে সুন্দরম পিসেমশাইয়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিল। পিসেমশাই জনার্দন মহাপাত্রের (৪৯) বাড়ি ওড়িশার গঞ্জাম জেলায়। জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে রিষড়ার শ্রীকৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। সত্যম এবং সুন্দরম স্থানীয় প্রভাসনগরের একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে একই সঙ্গে পড়াশোনা করে। তিন জনেই ট্রেনের ধাক্কা খান। জনার্দনবাবু ঘটনাস্থলেই মারা যান। সত্যম এবং সুন্দরমকে উদ্ধার করে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দু’জনকেই অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পথেই সত্যমের মৃত্যু হয়। সুন্দরমকে ভর্তি করানো হয় উত্তরপাড়ার একটি নার্সিংহোমে। তার বিপদ এখনও কাটেনি বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। হাসপাতালে সত্যমের মৃতদেহ নিতে এসেছিলেন জেঠামশাই প্রশান্ত পাণ্ডা। তিনি বলেন, “ভাইপোর দেহ নিতে এসেছি। আমার ছেলেটা নার্সিংহোমে। ডাক্তাররা সময় চেয়েছেন। কী হবে জানি না!” প্রশান্তবাবুও মহুয়াদেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। তিনি বলেন, “লোকজনের মুখে শুনেছি, উনি সত্যম, সুন্দরমকেও বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।”

-নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.