|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
বিশেষজ্ঞ না হলে ছবি দেখা বারণ? |
এই জাতীয় ধারণাকে ছুড়ে ফেলে ছবি-রসিক জনতার আমন্ত্রণ। এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে।
শিলাদিত্য সেন |
মেয়েটা স্কুলে পড়ত, উঁচু ক্লাসের ছাত্রী। হঠাৎ এক দিন জলে ডুবে মারা গেল। তদন্তে জানা গেলআত্মহত্যা। স্কুলেরই কিছু সহপাঠী সমবেত ধর্ষণ করেছিল তাকে...
চেনা লাগছে? টিভিতে, কাগজে প্রায়ই তো এমন গা-শিউরোনো খবর দেখি-শুনি-পড়ি আমরা। এ ঘটনাটা অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ার এক গ্রামীণ সম্প্রদায়ের। ঠিক মেয়েটিকে নিয়ে নয়, ওই সম্প্রদায়েরই এক বৃদ্ধাকে নিয়ে ছবি করেছেন লি চ্যাং-ডং(Lee Chang-Dang), ছবির নাম ‘পোয়েট্রি’। ছবিটির সুবাদে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছেন লি গত বছর কান ফিল্মোৎসবে। এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হচ্ছে ছবিটি।
লি অবশ্য জানিয়েছেন, শুধুমাত্র এই ঘটনাটিকে ছবির কাহিনি করে তুলতে চাননি। বরং এই ভায়োলেন্সকে কী ভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে জন্যই তাঁর ছবি করা। ছেষট্টি বছরের এক বৃদ্ধা তাই এ-ছবিতে মুখ্য। বৃদ্ধার নাম মিজা, তাঁর স্মৃতিলোপের অসুখ। শব্দ ভুলে যাচ্ছিলেন মিজা, স্থানীয় বয়স্ক শিক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে ক্লাস করা শুরুর পর সেখানকার শিক্ষক অন্যদের মতো তাঁকেও ‘কবিতা’ লেখা অভ্যেস করতে বলেন। কী হবে বিষয়? শিক্ষক বলেন: ‘দ্য বিউটি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’।
হেমন্ত বা শীতের পূর্ণ চাঁদের মায়া, পাতাঝরা, ধূসর পথ দেখতে দেখতে তিনি পদ্যের শব্দ চয়ন করেন বটে, কিন্তু কখনওই ভুলতে পারেন না মৃত মেয়েটির মুখ। যখন জানতে পারেন তাঁর প্রিয় বয়ঃসন্ধির নাতিটিও মেয়েটির ধর্ষকামী সহপাঠীদের এক জন, দুর্বহ মনে হয় তখন পৃথিবীটাকে। কবিতা সম্পূর্ণ করেন মিজা, কিন্তু তাতে নিসর্গের ম্লান ছায়া ও শূন্যতা। |
|
জীবন-ছবি! ‘পোয়েট্রি’ ছবির দৃশ্য। |
লি জানাচ্ছেন: যখন এই ঘটনাকে সামনে রেখে ছবি করবেন ভাবছিলেন, তখন এক দিন জাপানের এক হোটেলে বসে হঠাৎ টিভিতে খেয়াল করেন শান্ত একটি নদী, জেলেরা মাছ ধরায় নিবিষ্ট, জলে ছায়া ফেলে আকাশে উড়ে যায় পাখির দল। লি ছবিটির নাম দেবেন ‘পোয়েট্রি’, ঠিক করে ফেলেন তখন। তাঁর মনে হয়, কী শান্ত নিসর্গ, অথচ এরই ভিতর কী ভয়ঙ্কর হিংস্রতা নিয়ে বাঁচে মানুষ। কবিতা তাই শুধু সুন্দর হতে পারে না, তাকে দিনানুদিনের পাপে দগ্ধ হতে হয়। ‘পোয়েট্রি’ ছবিতে শব্দ-ভুলতে-বসা বৃদ্ধা তাই প্রতিরোধের শব্দ ফিরিয়ে আনেন তাঁর কবিতায়!
এ বারের উৎসবে ছবি বাছাবাছির দায়িত্বে যাঁরা, তাঁদের পুরোধা অঞ্জন দত্ত তো বলেই ফেললেন, ‘বরাবর সাহেবদের ছবিই সেলিব্রেট করেছি, এ বারে না হয় একটু এশিয়াকেই সেলিব্রেট করলাম।’ কোরিয়া, চিন, তাইল্যান্ড, জাপান ইত্যাদি এশিয়ার নানান দেশে তৈরি হওয়া সব ছবি তাক লাগিয়ে দিচ্ছে গোটা দুনিয়াকে। অঞ্জনের গলার স্বরে একই সঙ্গে প্রতিবাদ আর নতুনত্বের আবাহন। ‘ফিল্ম সোসাটির ফসল হিসেবেই কেবল দেখতে হবে ফেস্টিভ্যালকে, এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব কিন্তু বেরিয়ে আসছে এমন ধারণা থেকে।’ ছাঁচ ভাঙা ফেস্টিভ্যালের চালচিত্র চেনাচ্ছিলেন চলচ্চিত্রবেত্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। ভাল ছবি দেখার জন্যে তাঁকে সিনেমা-বিশেষজ্ঞ হতেই হবে বা সিনেমার তত্ত্ব জানতেই হবে, এমন ঠুলি-পরা কৌলীন্য গা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে ফেস্টিভ্যাল। ‘এ-শহর বা রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ যাতে অংশ নিতে পারেন, সে চেষ্টাই শুরু করেছি। সকলে ফিল্মোৎসব দেখুক, সেটাই চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ ফেস্টিভ্যালের সক্রিয় সংগঠক হরনাথ চক্রবর্তী যোগ করলেন। “এক বার জামশেদপুর গিয়েছিলাম, সেখানে এক দুধওয়ালা আমাকে বলেছিলেন: বাবু, জুতোর তলায় ধুলো মাড়িয়ে চলছেন, সমঝে চলবেন। ওই ধুলোই এক দিন ঝড় হবে, ‘আঁধি’, উড়িয়ে নিয়ে যাবে আপনাকে। ভুলিনি কথাগুলো, তাই ফিল্মোৎসবটাকে মুষ্টিমেয়র কুক্ষিগত হতে দিচ্ছি না, সকলের জন্য সব ধরনের ছবিই আছে এ উৎসবে।’’ ফেস্টিভ্যাল চেয়ারম্যান রঞ্জিত মল্লিকের শান্ত কথার মধ্যে প্রতিবাদের ধরন টের পাওয়া যায়। শুনতে শুনতে তাঁর প্রথম ছবি ‘ইন্টারভিউ’-এর একটা দৃশ্য মনে পড়ে যাচ্ছিল। ১৯৭০-এর কলকাতা। চলন্ত ট্রামের ভিড়ে দাঁড়িয়ে রঞ্জিত মল্লিক। সে ছবিতেও শেষটায় তাঁকে শান্ত স্বভাব থেকে প্রতিবাদে পৌঁছতে হয়েছিল, কারণ স্যুটের বদলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরায় চাকরির ইন্টারভিউতে বাতিল করা হয়েছিল তাঁকে। ছবিটা মৃণাল সেনের। দেখানো হচ্ছে এ বার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। |
|
|
|
|
|