|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
দমননীতি দিয়ে আত্মমর্যাদার আন্দোলন রোখা শক্ত |
এটা বোঝার মতো নমনীয়তা মূলধারার সমাজে অনুপস্থিত। তারা আদিবাসীদের একঘরে,
জঙ্গলনির্ভর করে রেখেছে; তার পর আবার নিজেদেরই প্রয়োজনে সেই জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার
উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবাদ করলেই শাস্তি, মাওবাদীর তকমা। প্রথম পর্ব
বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
১৯২০ সালে মাদ্রাজে দলিত সমাজের আন্দোলন ইতিহাসে ‘সেলফ রেসপেক্ট মুভমেন্ট’ হিসেবে খ্যাত। কিন্তু, একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আদিবাসী, দলিত সমাজের সব আন্দোলনই এক অর্থে ‘সেলফ রেসপেক্ট মুভমেন্ট’, যে কোনও প্রকাশ্য দাবি নিয়েই আন্দোলন হোক না কেন, তার মধ্যে আত্মমর্যাদার দাবিটি আছেই। সাম্প্রতিক কালের লালগড়ের আন্দোলনও মূলত আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠারই আন্দোলন।
২০০৮-এর ২ নভেম্বর তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাইন বিস্ফোরণের দায়ে যখন পুলিশ ঘুমন্ত গোরাচাঁদ মুর্মুকে বিছানা থেকে টেনে তুলে নিয়ে যায়, তখন তাঁর স্ত্রী চিন্তামণি বাধা দিতে এলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে তাঁর চোখে আঘাত করা হয়, চিন্তামণি অন্ধ হয়ে যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লালগড়ে প্রথম ‘পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনগণের কমিটি’ তৈরি হয়। তাঁরা ক্ষতিপূরণের অর্থ চাননি, তাঁদের মূল দাবিটি ছিল পুলিশ অফিসারকে ক্ষমা চাইতে হবে। বস্তুত গোটা জঙ্গলমঙ্গলে প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও পুলিশি অত্যাচারের ঘটনা ঘটে বলে অজস্র অভিযোগ। জঙ্গলমহলে নিত্য এই অন্যায় প্রতিকারের রাস্তা নেই, কারণ স্থানীয় থানাই সেখানে প্রশাসনের একমাত্র মুখ। গণতন্ত্রের আর কোনও প্রকরণ নেই। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে চিন্তামণির ঘটনায়। সেই আন্দোলনের পরিণামে জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনী নামে। রাষ্ট্র গোটা জঙ্গলমহলের মানুষকে ‘মাওবাদী’ তকমায় দেগে দেয়। যে কোনও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেখানে বন্ধ হয়ে যায়, এমনকী ‘জনগণের কমিটি’-র গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকারের দাবিকেও আসলে মাওবাদীদেরই আন্দোলন এই ছাপ দিয়ে দেওয়া হয়।
গত ২০০৯-এর এপ্রিল শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের স্বাস্থ্য শিবিরে লালগড়ে গিয়েছিলাম। চিন্তামণি মুর্মুর বাড়িতে বসে অত্যাচারের কাহিনি শুনে এসেছি। আমাদের সামনেই ঘটেছে আর এক ঘটনা। স্বাস্থ্য-শিবিরের ছাউনিতে আমরা নাম ও নম্বর লিখে টিকিট দিচ্ছিলাম। শিবিরে আন্দাজ আড়াইশো মানুষ এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুই প্রধানত রোগী। হঠাৎ ব্যানার লেখা একটি জিপ এসে থামে। সেই জিপ থেকে নানা রকম স্লোগান উঠছিল। গাড়ি থেকে কয়েক জন নেমে আসেন। বলেন, ‘স্বাস্থ্য-শিবিরের ডাক্তারদের অভিনন্দন জানাতে এসেছি।’
জনতা এককাট্টা হয়ে বলেন, ‘আপনাদের অভিনন্দন জানাতে হবে না। আপনারা ফিরে যান, আর ব্যানার খুলুন।’ জিপ থেকে ব্যানার খুলে তাঁদের চলে যেতে বাধ্য করা হয়। তাঁরা চলে গেলে, শিবিরে বসে থাকা মানুষজনের কাছে শুনেছি, এই যে ব্যানার নিয়ে এল, এর ফল মারাত্মক হতে পারে। পুলিশ খবর পেয়ে আসবে। ঘরদোর তছনছ করবে। তুলে নিয়ে যাবে যুবকদের। মারধর করবে। তখনই এক বৃদ্ধা বলেছিলেন, ‘মা গো! এক বার মাওবাদীরা এসে বলে, তিন জন দু’দিন থাকবে, খাবে। আবার পুলিশ এসে বলে, মাওবাদীদের থাকতে দিলে কেন? আমরা নিজেদের খাবার জোগাড় করতে পারি, না-পারি, ওদের খেতে দিতে হবে। তার পর পুলিশ এসে আর এক দফা অত্যাচার করবে। এই রকমই আছি।’
এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘জনগণের কমিটি’ যখন গঠিত হয়, আমরা যারা ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির মঙ্গলে বিশ্বাস করি না, তারা একটা আশার আলো দেখেছিলাম। জনগণের কমিটি তখন সমস্ত রাজনৈতিক দলের ব্যানার নিয়ে মিছিল বা মিটিং বন্ধ করেছিল। পুলিশের গ্রামে ঢোকাও বন্ধ হয়েছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। তারই মধ্যে যৌথবাহিনী নামিয়ে নতুন এক বিশ্বাসঘাতকতার বাতাবরণ তৈরি হল। শোনা যায়, যৌথবাহিনী নেমেই গ্রামের পানীয় জলের পুকুরগুলিতে মলমূত্র ত্যাগ করে বিষাক্ত করে তোলে। এমনকী হাতে গোনা কয়েকটি কুয়োকেও বাদ দেয়নি। ঘরে ঘরে ঢুকে যা সামান্য সঞ্চয়, তুলে নিয়ে যায়। বিনা বিচারে গ্রামের পুরুষদের ধরপাকড় চলল। ফলত গ্রাম পুরুষশূন্য। ২১ জুন কলকাতা থেকে আমরা কয়েকজন যখন লালগড়ে গিয়েছিলাম, তখন গ্রামের মানুষ জানিয়েছিলেন যে তাঁদের রান্না-খাওয়াও বন্ধ। কারণ, জঙ্গলে পাতা কুড়োনোর অধিকারও তাঁরা হারিয়েছেন। জঙ্গলে বন্দুক-হাতে যৌথবাহিনী পাহারা দিচ্ছে। সে দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছি। এই অবস্থায়, জনগণের কমিটি-র নেতা ছত্রধর মাহাতোকে বলি যে, মিডিয়ার সামনে বলতে যে তাঁরা মাওবাদী নন। তিনি বলেন। কিন্তু তেমন কোনও জোর ছিল না সেই বলায়। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সামনে বন্দুক, পিছনে বন্দুক। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কিছু বললে তারা ছেড়ে দেবে না।’
|
গ্রামবাসী = মাওবাদী! |
বার বার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাওবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই নাকি যৌথবাহিনী। খটকা লাগে। এমন বোধহয় কোনও দৃষ্টান্ত নেই, যেখানে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিয়েছে যৌথবাহিনী। এই সন্ত্রাসজীবন যাপন করতে করতেই জঙ্গলমহলের মানুষ শুনেছেন, তাঁরা নাকি সকলেই মাওবাদী। তাঁদের স্কুলবাড়ি হয়েছে যৌথবাহিনীর শিবির। কোনও রকম গণতান্ত্রিক কার্যকলাপের কোনও পরিবেশ নেই। সবই নাকি মাওবাদীদের ‘ফ্রন্টাল অরগানাইজেশন’, ‘জনগণের কমিটি’ও। তা-ই যদি হত, তা হলে ছত্রধর মাহাতো ভোটে দাঁড়ালেন কেন? সেখানকার মানুষ যদি মাওবাদী হয়ে যেতেন, তা হলে বলতে হবে, জঙ্গলমহল মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে গিয়েছে। তা যে এখনও হয়নি, তার প্রমাণ রাজনৈতিক দল সেখানে সভা করছেন, মিছিল করছেন। সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নানা অনুষ্ঠানে সেখানে মানুষ যোগ দেন। সবই কি মিথ্যা?
যৌথবাহিনী নামার পর থেকেই এখনও পর্যন্ত নানা অজুহাতে সেখানকার ছেলেদের কখনও পুলিশ, কখনও যৌথবাহিনী তুলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণ থাক বা না থাক, একটার পর একটা মামলায় তাঁদের আটক করা হয়। মামলা যে মিথ্যা, সেটা প্রমাণ করতে আদালতে যেতে হয়। সুদীর্ঘ সেই প্রক্রিয়া। এবং এঁদের সেই অর্থবল নেই। কার্যত বিনা বিচারে বন্দি সেখানকার শতাধিক যুবক। সত্তর দশকের পশ্চিমবঙ্গ আইনের অপব্যবহার দেখেছে, সেই একই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়ে চলেছে। ঘরের ছেলের মুক্তি দাবি করাকেও রাষ্ট্র এখন ‘মাওবাদী’ বলে দেগে দিতে চায়। যেন সাধারণ মানুষের নিজের কোনও দাবি থাকতে পারে না। বস্তুত জনগণের দাবিকে স্বীকৃতি দিলে দমননীতি চালানো যায় না। |
|
সশস্ত্র। কিন্তু, গণতন্ত্র-সম্মত? যৌথবাহিনীর টহল। লালগড়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
গোটা ভারতেই আমরা কখনও আদিবাসী মানুষকে সহনাগরিকের মর্যাদা দিইনি, রাষ্ট্রও তাদের নাগরিক প্রাপ্য দিতে প্রস্তুত নয়। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, উৎসব, বক্তব্য কিছুকেই আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। মূলধারার মানুষের মূল্যবোধের সঙ্গে না মিললে আমরা নিজেদের মতো করে তাদের ব্যাখ্যা করেছি। অত্যাচারের জবাবে যখন হতদরিদ্র মানুষ পুলিশ অফিসারকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে, টাকা বা বস্তুগত সুবিধা দিয়ে এই সব মানুষের মন পাওয়া যাবে না। তাঁরা আত্মমর্যাদার কথা বলেছেন। এটা বোঝার মতো নমনীয়তা মূলধারার সমাজে অনুপস্থিত। আমরা তাঁদের একঘরে, জঙ্গলনির্ভর করে রেখেছি; তার পর আবার নিজেদেরই প্রয়োজনে সেই জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। তখন তাঁরা প্রতিবাদ করলে, রাষ্ট্র বিরোধিতার আখ্যা দিয়ে দমননীতির আশ্রয় নিয়েছি।
জঙ্গল কেড়ে নেবার পন্থা সর্বত্র এক রকম নয়। আমাদের জঙ্গলমহলে যেখানে যেখানে শালের প্রাধান্য ছিল, সেখানে সেখানেই শাল গাছের বদলে ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়েছে। বন দফতর লাগিয়েছে। রুক্ষ লাল পাথুরে মাটির জঙ্গলে ইউক্যালিপটাস কেন?
বন দফতরের একাধিক কর্তার কাছে জানতে চেয়ে সদুত্তর পাইনি। ইউক্যালিপটাস মাটির তলার জল শুষে জায়গাকে আরও রুক্ষ করে তোলে। লালগড়ের একটি মেয়ে আমায় বলেছিলেন, ‘এ এমন গাছ দিদি, পাখি বসে না, ছায়া দেয় না। এমনকি গরু ছাগল খাবে যে তলায় ঘাস হয় না। আমাদের শাল গাছের পাতা, কাঠকুটো সব কাজে লাগে। এর কোনও কাজ নেই।’ তা হলে কি ধরে নেব জায়গাটির মাটির তলার জল নিঃশেষ করে আদিবাসী মানুষ যাতে বাস করতে না পারেন ভবিষ্যতে, তার জন্যই এই বিচিত্র বনসৃষ্টির পরিকল্পনা?
আদিবাসী মানুষ বন কেটে ফেলেছেন, এই অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাই। সেই অপরাধে পুলিশ তাঁদের ধরে। আমি একাধিক আদিবাসীর সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, তা এই রকম: কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওঁদের সামান্য মজুরি দিয়ে গাছ কাটিয়ে নেয়। ওই কাজ যে ঠিক নয় তা ওঁরা জানেন। কিন্তু ক’দিন মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে? পুলিশ কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কখনও ধরে না। বন কী করে রক্ষা করতে হয়, ওঁদের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সেই জ্ঞানকে বন দফতর কখনও কাজে লাগাতে চায় না। অথচ, একটু চাইলেই তা করা যেত। |
(চলবে) |
|
|
|
|
|