শেষ যাত্রা তো নয়। এ শেষ আগমন। তিনি গেয়েছিলেন ‘মানুষ মানুষের জন্য।’ গত কাল থেকে অসমের সব মানুষ কেবল, ওই মানুষটার জন্যই জড়ো হয়েছেন। বিমানবন্দরে মরদেহ নামার পর থেকে যে জনতার ঢল ভূপেন হাজরিকার কফিনবন্দী দেহের পিছু নিয়েছিল, সময় যত গিয়েছে সেই ঢল হাজার পেরিয়ে লক্ষও ছাড়িয়ে গিয়েছে। মানুষের চাপে, আজ অন্ত্যেষ্টিই স্থগিত করে দিতে হল। আগামী কাল সকাল সাতটা নাগাদ ভূপেনবাবুকে দাহ করা হবে। বেদুইন জীবন শেষে, একেবারের জন্য এই ‘রূপহী অসম’-এর বুকে, লোহিত পাড়েই স্থায়ী ভাবে থেকে যাবেন যাযাবর।
ধনী-দরিদ্র, অসমীয় বা অ-অসমীয়, জঙ্গি-পুলিশ কোনও ভেদাভেদ নেই এই জনস্রোতে। আজকের অসমে কেবল মাত্র দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন। এক) যাঁরা ভূপেনবাবুর মরদেহ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং দুই) যাঁরা করেননি। গুয়াহাটি-সহ গোটা অসমে এক অঘোষিত, সর্বাত্মক ‘বন্ধ’ চলছে যেন। সরকারি নির্দেশে দফতর-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ছিল। কিন্তু রাস্তার একটি দোকানের জন্য তো সে নির্দেশ ছিল না। তবু একটি দোকানও আজ খোলেনি। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন, গাড়িতে কেবলই জাজেস ফিল্ডমুখী মানুষের ঢল। স্বচ্ছ, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাক্সে বিশ্রামরত তিনি। সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটে ক্লান্ত। বিমান বন্দর থেকেই, গানে গানে ভূপেন বন্দনা চলছে। এক দিকে ‘প্রতিধ্বনী’ থামলে, অন্য দিকে শোনা যাচ্ছে ‘আকাশি গঙ্গা।’ কেবল অসমীয় গানই নয়, ভুপেনবাবুর দেহের পাশে বসে, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের প্রতিনিধিরাও একের পর এক গণসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গণনাট্যসঙ্ঘের প্রয়াত স্তম্ভকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। |
গত কাল, বিমানবন্দর থেকে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, মালিগাঁও, সোনারাম ফিল্ড, কটন কলেজ, দীঘলিপুখুরি হয়ে রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ নিজরাপাড়ের বাড়িতে পৌঁছয় কফিনবাহী কনভয়। রাতে আসে জাজেস ফিল্ডে। গোটা রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসীম আগ্রহে অপেক্ষমান জনতা। গত কাল থেকেই ‘ভূপেনমুখী’ মানুষের জন্য পথেঘাটে ভুপেনের ছবি লাগিয়ে খোলা হয়েছে জলসত্র। লাইন জুড়ে কেবল বিকোচ্ছে ফুল-মালা। রাত থেকে চারটে লাইন দিঘলীপুখুরি ও কটন কলেজকে পাক খেয়ে চলেছে। ছয় কিলোমিটার লম্বা লাইনে জনতার ঢল সামলাতে নাজেহাল পুলিশকর্তারা। বেলা দু’টো নাগাদ ভূপেনবাবুকে ‘শেষ দর্শন’ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দেড় লক্ষ ছাড়িয়েছে। বাইরে আরও লক্ষাধিক অপেক্ষমান। মাঠে, ভিড়ের চাপে সংজ্ঞা হারান একাধিক ব্যক্তি। আজ বেলা দুটো অবধি দেহ দর্শনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু গোটা অসম থেকে আসা মানুষের ঢেউ দেখে সিদ্ধান্ত পালটাতে বাধ্য হলেন ভূপেনবাবুর পরিবার ও প্রশাসন।
সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রণতি ফুকন জানান, “আজ শেষকৃত্য স্থগিত রাখা হচ্ছে। আগামী কাল ভোর পাঁচটা অবধি ভুপেনদাকে দেখতে পারবেন সকলে। সকাল ছ’টায় মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হবে। সাতটায় গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু উদ্যানে অন্ত্যেষ্টি। বেলা ১২টা অবধি সব দফতর ও দিনভর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।” অন্ত্যেষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীর প্রতিনিধিত্ব করবেন উত্তরপূর্ব উন্নয়নমন্ত্রী পবনসিংহ ঘাটোয়ার।
সরকারের তরফে ভূপেনবাবুর পদচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য ফরেনসিক দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ভূপেনবাবুর স্মৃতিসৌধ ও তাঁর নামাঙ্কিত ভবন গড়ার জন্য ৬২ একর জমি দেওয়া হচ্ছে। দাহ করার জন্য চন্দন কাঠের ব্যবস্থাও করছে বিশ্ববিদ্যালয়। অসম সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে জোড়া হচ্ছে ভূপেনবাবুর নাম।
আজ নিউ ইয়র্ক থেকে অসম পৌঁছে আবেগের ঢেউ দেখে মুগ্ধ ষাট বছরের ছেলে তেজ হাজরিকা। বললেন, “রাজ্য তথা গোটা দেশে বাবার জন্য এত আবেগ জমে ছিল! ভাবা যায় না। মায়ের হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হবে তাই তিনি আসতে পারছেন না। ছেলে আকাশ কয়েক দিনের মধ্যেই এসে পড়বে।” অসংখ্য মানুষের হাহাকার সাক্ষী রেখে, অসমে ‘বুড়া লুইত’ আর বাংলায় গঙ্গা একইভাবে বয়ে চলেছে। আর মাইকে ভেসে আসছে ভূপেনবাবুর আবৃত্তি, “মৃত্যু জীবনর পরা কিমান দূর? মোয় মোর পরা কিমান দূর? (মৃত্যু জীবনের চেয়ে কতটা দূর? আমি আমার চেয়ে কতটা দূর?)।” |