বাঁধ ভাঙল চোখের জলের!
রাজনাথ সিংহ বললেন, “আপনিই যোগ্যতম। তাই তো অটলবিহারী বাজপেয়ী আপনাকে প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী করেছিলেন।” অরুণ জেটলি বললেন, “আধুনিক বিজেপির তিনিই প্রধান স্থপতি।” আজ ৮৫ বছরে পা দিয়ে এ সব শোনার পর লালকৃষ্ণ আডবাণী আর কী ভাবে চোখের জল আটকাবেন!
গত বছরের জন্মদিনে তিনি ছিলেন অনেকটাই নিঃসঙ্গ। কিন্তু পরের মাত্র একটা বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আজ ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়ির সামনেটা গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। সকাল থেকে নেতা ও কর্মীদের ভিড়। হাতে পুষ্পস্তবক, নানা ধরনের উপহার। সুষমা স্বরাজ এসেছেন চকোলেট কেক নিয়ে। কেক কাটলেন আডবাণী-কন্যা প্রতিভা। সুষমা, রাজনাথ, জেটলি, যশোবন্ত সিংহ সুর করে গাইলেন ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’। সাতসকালেই এসেছিলেন সভাপতি নিতিন গডকড়ী। দলীয় মুখ্যমন্ত্রীরা প্রায় সকলেই এসেছিলেন। ছিলেন না শুধু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জরুরি প্রয়োজনে তিনি চিনে গিয়েছেন। এই সফরের জন্য আজ তিনি গুজরাতের প্রধান বিচারপতির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও হাজির থাকতে পারেননি। মোদী এই সফরের কথা আডবাণীকে জানিয়েওছেন। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান বললেন, “আমি রোজ ১৩-১৪ ঘণ্টা এ প্রান্ত-ও প্রান্ত ঘুরি। কিন্তু আডবাণী যখন আমার রাজ্যে আসেন, তখন বুঝতে পারি, আমার পরিশ্রমটা কিছুই নয়। ওঁর সঙ্গে রথযাত্রায় গিয়ে আমি হাঁফিয়ে পড়ছিলাম। যখন আমার মনে হচ্ছে, এ বার একটু জল খাই বা একটু বসি, তখন আডবাণী বলতেন, এ বার কোথায় যেতে হবে?” মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সভাগৃহে সমর্থকদের হাততালি। সঙ্গে হাসির রোল। আজ অন্তত আডবাণী এটা বুঝিয়ে দিলেন যে, এখনও তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক। এক শীর্ষ বিজেপি নেতার সরস মন্তব্য, “জন্মদিনের বার্তা একটাই। বুড্ডা হোগা তেরা বাপ!” |
মধ্যপ্রদেশে সঙ্ঘের যে সংবাদপত্র গোষ্ঠী রয়েছে, তারা আজ জন্মদিন উপলক্ষে আডবাণীকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করে। সেখানে আডবাণী সম্পর্কে বিভিন্ন বিজেপি নেতা তো বটেই, এমনকী অন্য দলের রাজনৈতিক নেতারাও প্রবন্ধ লিখেছেন। চোখের জল মোছার জন্য প্রতিভা বাবাকে বারবার এগিয়ে দিচ্ছিলেন টিস্যু পেপার। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা বললেন, “আমি যদি ওঁর সম্পর্কে কিছু বলি, সেটা হবে সূর্যের সামনে বাতি দেখানোর সমান।” চোখের জল মুছে আডবাণী বললেন, “শুধু দুঃখে নয়, গভীর আনন্দেও আমার চোখে জল আসে। এক বার কোনও একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম, যাদের ভিতর আবেগ খুব বেশি, তারা অনেক সময় আনন্দেও কাঁদে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিয়ে আমার একটি পরিবার রয়েছে। আর একটি পরিবারের সদস্য হয়েছিলাম ১৪ বছর বয়সে। সেটি হল আরএসএস। আজ যাঁরা আমার প্রশংসা করছেন, তাঁরাও আমার পরিবারের সদস্য। আমাকে ভালবেসে প্রশংসা করছেন। আর তাই আমার চোখে জল।” জেটলিকে দেখে আডবাণী বললেন, “তোমার শরীর ভাল আছে তো?” হাসতে হাসতে অরুণ বললেন, “এ প্রশ্নটি তো আমারই আপনাকে করা উচিত। আপনি যা পরিশ্রম করছেন!” পরে অরুণ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “শুধু পরিশ্রম নয়। আডবাণীর সব থেকে বড় ক্ষমতা হল, তিনি একটি বিষয়কে বেছে নিয়ে সেটিকে জাতীয় আলোচ্য করে তুলতে পারেন। গোটা দলকে সেই বিষয় ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতেও পারেন। তিনি আমাদের মার্গ দর্শক।” মধ্যপ্রদেশে সঙ্ঘের যে মুখপত্রটি রয়েছে, সেই পত্রিকা গোষ্ঠীর সম্পাদক রাজেন্দ্র শর্মা বলেন, “বিগত লোকসভা নির্বাচনে আডবাণী ছিলেন বাজপেয়ীর ভূমিকায়। কিন্তু তাঁর পাশে তখন কোনও ‘আডবাণী’ ছিল না।” প্রধানমন্ত্রী পদ প্রসঙ্গও উঠেছে তাঁর কথায়। বলেছেন, “অনেকে বলেন আডবাণী প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার। আমি বলি, আডবাণীর মতো নেতা প্রধানমন্ত্রী পদ কেন চাইবেন? দেশ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদ দেবে।” রাজনাথ সিংহও বলেন, “আডবাণী কোনও দিন প্রধানমন্ত্রী পদ চান না। বাজপেয়ী তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রার্থী করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য।”
এমন নয়, বিজেপি দলের মধ্যে নেতৃত্বের সঙ্কট ঘুচে গিয়েছে। এমন নয়, প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে লড়াই থেমে গিয়েছে। এ সবের মধ্যেই আডবাণীকে ঘিরে আজ এই সব মন্তব্য উঠে এল। আবার তার ভিতরেই বাজপেয়ীর বাগ্মিতার সঙ্গে সুষমার বাগ্মিতার তুলনা করলেন আডবাণী। বললেন, “এক সময় বাজপেয়ীর বক্তৃতা শুনলে মনে হত, আহা যদি এত ভাল বক্তা হতে পারতাম! এখন সুষমার বক্তৃতা শুনলে সেই ‘কমপ্লেক্স’ হয়।” প্রশংসায় অভিভূত সুষমা প্রণাম জানান আডবাণীকে।
আসলে অভ্যন্তরীণ লড়াই না থামলেও এক দিকে ইউপিএ-র নানা ব্যর্থতা আর তারই মধ্যে আডবাণীর দীর্ঘ রথযাত্রা যে দলে গভীর প্রভাব ফেলেছে, সেটা এক বাক্যে সব বিজেপি নেতাই স্বীকার করছেন। দিল্লির বিজেপি নেতা বিজয় গোয়েল বলেন, “প্রথমত, দুর্নীতি নিয়ে অণ্ণা হজারে বা রামদেব যখন আন্দোলন করছিলেন, তখন বিজেপির কর্মসূচি ছিল ন। বিজেপি আন্দোলন শুরু করায় অণ্ণার জায়গাটি আমরাই নিয়েছি। দ্বিতীয়ত, এই রথযাত্রার ফলে সমর্থকেরা চাঙ্গা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিজেপির শীর্ষ নেতারাও আডবাণীর উৎসাহে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাই বিজেপির লাভ ষোলো আনার উপর আঠারো আনা।” কাল ফের রথযাত্রায় বেরোচ্ছেন আডবাণী। লক্ষ্য কংগ্রেসশাসিত রাজস্থান। সেখান থেকে পঞ্জাব। তার পর হরিয়ানা। কমলা আডবাণীর শুধু আক্ষেপ, “বাড়িতে এখন নাতনি এসেছে। তাই এ বার রথযাত্রায় তেমন ভাবে সামিল হতে পারিনি। তবে ইচ্ছা রয়েছে, যাত্রা শেষের আগে একবারে হরিয়ানায় যাব। সবাই বলছে, এই যাত্রাটাই সব থেকে সেরা।” |