এত দিন রাস্তার উপরে অস্থায়ী ঘরে ‘বেআইনি’ ভাবে টোল আদায় হচ্ছিল। অন্তত জেলা প্রশাসনের সেটাই দাবি। সেই টোল বুথটি মঙ্গলবার বিকেলে ভেঙে দিল প্রশাসন।
ঘটনাটি তারাপীঠের। এই ঘটনাকে ঘিরে বামফ্রন্ট পরিচালিত বীরভূম জেলা পরিষদ এবং প্রশাসনের মধ্যে কাজিয়া শুরু হয়েছে। জেলা পরিষদের সভাধিপতি, সিপিএমের অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায় গোটা ঘটনার জন্য রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক এবং রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রীকে দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, তৃণমূলের ‘চাপে পড়েই’ প্রশাসন ওই টোল বুথ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠেছে, অনেক বছর ধরেই প্রশাসনের নাকের ডগায় ওই রাস্তার উপরে টোল আদায় হচ্ছে। এত দিন তা হলে প্রশাসন কী করছিল?
প্রশাসনিক কর্তারা অবশ্য সভাধিপতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। টোল বুথ রামপুরহাট-সাঁইথিয়া পাকা সড়কের উপরে তারাপীঠ ঢোকার আগে রামপুরহাট থানার কবিচন্দ্রপুর মোড় সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার উপরে ওই টোল বুথটি ছিল। জেলা পরিষদই নলহাটির একটি এজেন্সিকে টোল আদায় করার অনুমতি দিয়েছিল। এ দিন সকালে এজেন্সির লোকজনদের রামপুরহাট মহকুমা প্রশাসনিক ভবনে ডেকে বলে দেওয়া হয়, মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে টোল আদায়ের অস্থায়ী অফিস সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তখন মহকুমাশাসক বৈভব শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, “ওই এজেন্সি এত দিন নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে রাস্তার উপরে অস্থায়ী বুথ করে টোল আদায় করছিল। সেটা তাদের বন্ধ করতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশ মেনে তারাপীঠে ঢোকার মুখে থাকা ওই টোল বুথ যদি এজেন্সিটি সরিয়ে না নেয়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এ দিন বিকেলেই পুলিশের উপস্থিতিতে বুথটি ভেঙে দেয় প্রশাসন।
|
এই সেই অস্থায়ী টোল-বুথ। মঙ্গলবার বিকেলে ভেঙে দেওয়া হয় বুথটি। নিজস্ব চিত্র। |
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, তারাপীঠের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদ ওই এলাকার পার্কিং প্লাজায় টোল আদায়ের ব্যবস্থা করেছে। এ বছর ১২ জুলাই জেলা পরিষদের ডাকা দরপত্রের ভিত্তিতে এক বছরের জন্য ১৭ লক্ষ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বর্তমান এজেন্সিটি টোল আদায়ের অনুমোদন পায়। বীরভূমের অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) সৌম্যজিৎ দাস বলেন, “তারাপীঠে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে এবং স্থানীয় ফুলিডাঙা এলাকার মোট দু’টি জায়গায় তারাপীঠে যাতায়াতকারী গাড়ি রাখার জন্য পার্কিং প্লাজা করা হয়েছে। সেই মতো বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্সির ওই দুই পার্কি প্লাজা থেকেই টোল আদায় করার কথা। অথচ তারা বেআইনি ভাবে তারাপীঠ ঢোকার আগে রাস্তার উপরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে টোল আদায় করছিল। এটা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য মহকুমাশাসককে বলা হয়েছিল। প্রয়োজনে ওই এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। সেই মতো মহকুমাশাসক ব্যবস্থা নিয়েছেন।”
মহকুমাশাসকের নির্দেশ মোতাবেক তাঁরা অস্থায়ী অফিস সরিয়ে নেবেন বলে টোল আদায়কারী এজেন্সির পক্ষে জানিয়েছেন শুভদীপ দাস। তবে একই সঙ্গে তাঁর ক্ষোভ, “জেলা পরিষদকে ঠিক করে দিতে হবে, পার্কিং প্লাজা বলতে তারা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে। এ বছর জুলাই মাসে আমরা টোল আদায় করার দায়িত্ব পাই। পুরনো এজেন্সি যে জায়গায় টোল আদায় করত, সেখানেই আমাদের এজেন্সিও টোল নিচ্ছে। এতদিন তো জেলা পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনও আপত্তি আসেনি।”
শুভদীপবাবুর আরও দাবি, টোল আদায় সংক্রান্ত জেলা পরিষদের বিজ্ঞপ্তিতে পরিষ্কার করা নেই যে, ঠিক কোন জায়গায় টোল আদায় করতে হবে। তিনি বলেন, “ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, তারাপীঠের মধ্যে চলাচলকারী অটো রিকশা, ট্রেকার, স্থানীয় রুটের বাস, লরি, ট্যুরিস্ট বাস প্রভৃতি যানবাহনের থেকে টোল আদায় করা যাবে। এখন আমরা বুঝতে পারছি না টোল আদায় করব কী ভাবে। হঠাৎ করে প্রশাসন আমাদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল। পার্কিং প্লাজায় আসা গাড়ির সংখ্যা অনেক কম। সেখান থেকে টোল আদায় করতে হলে আমাদের বিরাট আর্থিক লোকসানের মুখে পড়তে হবে। পাশাপাশি এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৪০ জন যুবক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলেন।”
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক সৌম্যজিৎবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “যাঁরা পার্কিং প্লাজাই বোঝেন না, তাঁরা কী ভাবে টোল আদায় করবেন?” এই অবস্থায় তাঁরা আইনি পদক্ষেপ করার ভাবছেন বলে জানিয়েছেন শুভদীপবাবু।
জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তৃণমূল বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পর্যটন মন্ত্রী রচপাল সিংহ প্রশাসনের উপরে চাপ সৃষ্টি করে এই অন্যায় করেছেন। তারাপীঠের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে পার্কিং ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত। ওই এজেন্সিকে কোনও নির্দিষ্ট জায়গা বলে দেওয়া হয়নি। তারা রাস্তায় টোল আদায়ের বুথ করে কোনও অন্যায়ও করেনি। বিনা কারণে এ ভাবে জেলা পরিষদের নির্বাচিত সংস্থাকে বাতিল করে দেওয়া হল কোনও লিখিত নির্দেশ ছাড়াই। এতগুলো লোককে রুজিহীন করে দেওয়া হল।” তিনি জানান, গোটা বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে কথা বলবেন।
অতিরিক্ত জেলাশাসকের অবশ্য দাবি, “হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এর আগেও এজেন্সিকে রাস্তার উপরে টোল আদায় না করার জন্য সতর্ক করা হয়েছিল। তারা শোনেনি। তবে টোল বুথটি ভাঙার ব্যাপারে কিছু জানা নেই।”
সভাধিপতির আরও অভিযোগ, “তৃণমূল পরিচালিত অনেক পুরসভাই পূর্ত দফতরের জায়গায় টোল আদায় করছে। সেখানে তো কোনও রকম আপত্তি বা বাধা আসছে না! আসলে সোমবারই তারাপীঠ পরিদর্শনে এসেছিলেন পর্যটন মন্ত্রী। তার পরেই ওই এজেন্সিকে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এর ফলে জেলা পরিষদের ক্ষমতাকেই খর্ব করা হল। আমরা এর প্রতিবাদ করছি।”
সভাধিপতির অভিযোগ অস্বীকার করে আশিসবাবুর দাবি, “পুরসভা রাস্তা সংস্কারের জন্য রাস্তা থেকেই টোল আদায় করে। এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। জেলা পরিষদও যদি রাস্তা সংস্কারের জন্য ওই ভাবে টোল আদায় করত, তা হলে কিছু বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তারা পার্কিং ফি আদায়ের নামে তারাপীঠে যাতায়াতকারী গাড়িগুলি থেকে এতদিন জুলুমবাজি করে তোলা আদায় করে এসেছে। এখন নিজেদের স্বার্থে ঘা পড়ায় সভাধিপতি উল্টোপাল্টা বকছেন। এর মধ্যে অহেতুক পর্যটন মন্ত্রীর নাম জড়ানোরও চেষ্টা চলছে।” বিধায়কের আরও দাবি, “জেলা পরিষদ বরং হিসাব দিক, এত বছর ধরে বিভিন্ন টোল আদায়কারী এজেন্সির কাছ থেকে পাওয়া লক্ষ লক্ষ টাকায় তারা তারাপীঠের কী উন্নতি করেছে?” |