প্রবন্ধ...
হে রাম!
হুবিচিত্র সংস্কৃতির দেশ আমাদের, নানা কারণে বা অকারণে চট করে এক-একটা সংবেদনে ঘা লেগে যায়। পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনই একটি পরিসর, যেখানে কর্তাভজা আদর্শ ছেড়ে বহুবিধ বুদ্ধিবৃত্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির চর্চার সম্ভাবনা বর্তমান। ক্লাসরুমের ভেতরে, বাইরেও। সংকট তখনই চূড়ান্ত, যখন কোনও ধর্মীয় সংবেদনে আঘাত লাগছে বলে জ্ঞানচর্চার পরিসর জোরজুলুম ছোট করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস থেকে এ কে রামানুজনের ‘থ্রি হানড্রেড রামায়াণস: ফাইভ এগজাম্পলস অ্যান্ড থ্রি থট্স অন ট্রানস্লেশন’ প্রবন্ধটিকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এটা ওই একই আগ্রাসনের ফল। প্রবন্ধটিতে বাল্মীকি রামায়ণ ও মনোমোহন রামের অযথা কুকীর্তন করা হয়েছে বলে যাদের গেরুয়া এত গরগরে, তারা হয়তো কেউ একটা বর্ণ মূল বাল্মীকি পড়েনি, ঘোর গুপ্ত গুহ্য শারীরবৃত্তীয় সংকেতময় ধর্মচর্চাও যে ‘হিঁদু’র নিজস্ব, তা জানেই না। ধর্মবিদ্যার দৌড় অমর চিত্রকথা, রামসীতা বললে তেল চকচক ক্যালেন্ডারে সিল্কশোভিত নধর অরুণ গোভিল ও দীপিকা চিকলিয়া, অথচ অন্যান্য ভাষার আধারিত রামায়ণ গল্পগুলি নিয়ে প্রসঙ্গের মিল ও বিষয়ের বিভেদবৈচিত্র আলোচনা করা হলেই হিন্দু ধর্মের পবিত্র মর্মর সৌধে ইয়ে লেগে গেল বলে খড়্গহস্ত।
রামানুজন বলেন যে, একটি রামায়ণ নেই। আছে রামকথা। শুধু রামানুজন কেন, এ গত তিরিশ বছরে পুষ্ট বিপুলায়তন এক স্কলারশিপ, যা সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে রামায়ণের গল্পের প্রবাহ ও প্রচলনে পড়বার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, একমাত্রিক ঐতিহাসিক সত্যের বাইরে থেকে আখ্যান হিসেবে দেখার চর্চা। যার নাম রামকথা। তা থেকে মানব অভিপ্রায়ের ইতিহাস বোঝা যায়। কিন্তু গেরুয়া মন সে কথা বুঝবে কেন? অতএব রামানুজন মুর্দাবাদ।
ঘটনার শুরু ২০০৮-এ। বিজেপি সমর্থিত অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এ বি ভি পি) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধানের ঘরে ভাঙচুর চালায় এই প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে। প্রবন্ধটি সিলেবাস থেকে বহিষ্কৃত করার দাবি নিয়ে বিতর্ক সুপ্রিম কোর্ট তক যায়। কোর্টের নির্দেশে চার বিশেষজ্ঞের দল প্রবন্ধটি পড়েন। তিন জন আপত্তির কোনও কারণ খুঁজে পান না, মাত্র এক জনেরই মনে হয়, এই বহুস্তরী প্রবন্ধটি বোঝাতে ও বুঝতে শিক্ষক-ছাত্র উভয়ের খামতি থেকে যেতে পারে, তবে তিনিও প্রবন্ধটি নিয়ে কোনও আপত্তি জানাননি। অথচ এর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ডাকা অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে ভোটাভুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষণের দোহাই দিয়ে উপস্থিত ১২০ জনের মধ্যে ন’জনের টিমটিমে বিরোধিতাকে সরবে প্রত্যাখ্যান করে রামানুজনকে বাদ দেওয়া হয়।
প্রবহমান। রাম-কথা। তামিল রামায়ণ।
এই আঁতে ঘা লাগার কারণ, ভারতীয় ইতিহাস ও হিন্দুধর্ম বলতে এরা যা রচে তুলেছেন, তা ইতিহাসের প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রাপ্ত নয়। মহাকাব্য বা পুরাণ, যা-ই স্মৃতিশাস্ত্রের মধ্যে পড়ে, তা আখ্যানধর্মী। আখ্যান থেকে ইতিহাস চেতনাকে আমরা বুঝে নিতে পারি বটে, কিন্তু তা-ই ঘটিত ইতিহাস, এমনটা ঠাউরে নিলে মনে হতে পারে বাল্মীকি রামায়ণ সত্য, বাকি সব প্রক্ষিপ্ত। বাদ পড়ে যেতে পারে এই ধারণা যে, একই গল্প নানা ভঙ্গিমায়, নানা ছলে বলা হলে নানা নতুন অর্থ উৎপন্ন করে।
বার বার বলার ফলেই তৈরি হয়েছে রামায়ণের প্রায় আড়াই হাজার বছরের দীর্ঘ পরমায়ু। বাল্মীকি নিশ্চয় আদি পাঠ, Ur-text। কিন্তু, তা-ও এই এবিভিপি যে ভাবে তার লেখককে লিখতে দেখে, তির সন্ধান করেই, একা একা এক সিটিংয়ে নামিয়ে দেওয়া সপ্তকাণ্ড, এ রকম নয়। মৌখিক রীতির চারণকবি দলের যৌথতায় এর সৃষ্টি। বাল্মীকি রামায়ণ খুললে তো এই নারদ এই গল্প বলেন, তো ওই গল্প বলেন শিব। আমাদের এবিভিপি এ জেনে হার্টফেল না-করে বসে যে বাল্মীকির রাম অবতার অবধি নন। তিনি নিতান্ত পুং। অতি উত্তম ও অতি আদর্শ পুং যদিচ। এবং বাল্মীকির ছাড়াও তাঁরই সময়ে বৌদ্ধ ও জৈন রামায়ণ ছিল।
ফলত, চাপা পড়ে যায় কল্পনার অজস্র বৈভব। তিব্বত, তাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস, কাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, জাভা, ইন্দোনেশিয়ায়। দেশের মধ্যে অজস্র অবিরল মিলে ও বিভেদে। একই রামের গল্প তো একই ভাষায় মানুষ ফিরে ফিরে লিখেছে, ভিন্ন ভিন্ন অর্থ তৈরি করেছে। তা থেকেই তো আসলে জীবনকে বোঝা যায়, এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যের, এক সংস্কৃতির সঙ্গে অপরের যোগ-ভেদ বোঝা যায়। গবেষক ক্যামিল বাল্ক তিনশোটি রামায়ণ খুঁজে পেয়েছিলেন ১৯৫০-এই।

এবিভিপি-র আপত্তি সেই বহুত্বে নয়। রামানুজন এত রামায়ণ ছেড়ে যে-সব উদাহরণ দিয়েছেন, তা তাদের কাছে অনৈতিক ও অশ্লীল। জাতকের দশরথ রামায়ণে রাম-সীতা ভাইবোন। কিন্তু একে অজাচার হিসেবে দেখলে আমরা এই সম্পর্কে নিহিত সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতীককে না-ও বুঝতে পারি। যেমন, কন্নড় রামায়ণে যোগীর তুক করা আমের আঁটিটুক রাবণ লোভবশে মন্দোদরীকে দিয়ে নিজে শাঁসটুকু খেলে রাবণের গর্ভাধান হয়ে যায়। হাঁচির ফলে রাবণের নাক থেকে জন্ম নেন সীতাম্মা। কন্নড়ে সীতা মানে হাঁচি। এই আশ্চর্য লোককথা মহাকাব্য সমন্বয়, শ্রেষ্ঠ সতীর নামের সঙ্গে নিচুস্তরীয় শারীরিক ক্রিয়ার নাম যুক্ত হয়ে টেক্সটের যে নবরূপ পরিগ্রহণ, তাতে রামের মর্যাদাহানি হয়, কারণ রামের মর্যাদার ভূত তৈরি করা, সেই ভূত পোষা, ভূতের ভয় দেখানো যাবে বলেই। আর, যে সমস্কৃত নিয়ে এদের এত আকুলি-বিকুলি, সেই পরম ভাষাতেই পুরাণে কন্যার প্রতি শিবের কাম, যুবনাশ্বের গর্ভাধান ইত্যাদি লিখিত। সেই ভাষাতেই ২৫টি রামায়ণ আছে। অধ্যাত্মরামায়ণে সীতাকে রাম যখন বনবাসে সঙ্গে নিতে চান না, স্ত্রীর কর্তব্য-টর্তব্য বলেও কূল না পেয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠেন সীতা যে, আগে শত শত রামায়ণে সীতা রামের সঙ্গে বনে গেল, আর আজ উনি গররাজি!

উনিশ শতকের গোড়ায়
একটি ছবিতে রাম-রাবণের যুদ্ধ।
এটা কুযুক্তি যে, সমস্ত শিক্ষক বহুস্তরী প্রবন্ধ বোঝাতে পারবেন না, বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা তার জটিলতা বোঝাতে-বুঝতে পারবেন না। শিক্ষকতা অ-দীক্ষিত রোয়াক-বক্তৃতা নয়, তা বিজ্ঞান বা ইতিহাস বা সাহিত্য বা সমাজবিজ্ঞানের নিজস্ব মতাদর্শ দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। আর অন্য ধর্মাবলম্বী বা অপরত্বের যুক্তিতে আমরা চর্যাপদ দূরে থাক, চণ্ডীদাসকেও কি বুঝে ওঠার অধিকার রাখি? কাজেই এই ধরনের আলোচনাগুলি মননের অধিকার ক্রমে খর্ব করে। রামানুজন এই প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে বরং তারই বিপরীতে ভাবনার এক ভারতীয় তরিকা (এও রামানুজনের আর এক প্রবন্ধের নাম) উসকে দিতে চাইছেন। যে বহুকথনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবন। যাতে ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের-ইতিহাসের মধ্যে নানা দিক থেকে আলো ফেলতে পারে, যুক্তির। নানা অর্থ উৎপন্ন করে ভারতীয়ত্বের। ইতিহাসের।
যে পরিসরে আমাদের জ্ঞানের নিজস্ব চর্চা নিশ্চিন্ত আছে ভাবি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ যুক্তির বাইরে গিয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, শিক্ষার ভাষায় কথা না-ও বলতে পারে, অন্যের যুক্তিটুকু জানার প্রয়োজন বোধ না করে তার স্বাতন্ত্র মুহূর্তে খর্ব করতে পারে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় একটা বিপুল সংকটের মুখোমুখি হল শিক্ষাব্যবস্থা, যে কোনও জ্ঞানশৃঙ্খলার স্বাধিকার আছে, না বাইরের বুরবক প্রতিক্রিয়াতেই সেই জ্ঞানের বাইরের কিছু মানুষ ভোটাভুটিতে খর্ব করতে পারেন জ্ঞানচর্চার ও বিভাগীয় গণতান্ত্রিক অধিকার!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সেমেস্টার (স্নাতক) বাল্মীকি রামায়ণকে মূল পাঠ ধরে কম্বন লিখিত তামিল ইরামাবতারম ও তুলসীলিখিত রামচরিতমানস পড়ানো হয়। রামানুজনের ‘তিনশোটি রামায়ণ’ সেখানে অবশ্যম্ভাবী সহায়ক পাঠ। সেই পাঠনের-মননের একটি ভারতীয় তরিকার খোঁজে। গেরুয়ারা জবরদস্তি করবেই, কিন্তু ভূতের ভয় যে তাড়াবে, সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই যদি ভূত বসে থাকে, তা হলে?
এ যদি ঘোর সংকট না হয়, তবে সংকট কাকে বলে?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক  


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.