আমার মন কোথায় গেল? কে লইল? যেখানে রাখিয়াছিলাম, সেখানে ত নাই। পাঠমাত্রে বঙ্গজনতা বুঝিবেন, শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী উবাচ। অথচ, বঙ্কিমচন্দ্রের অন্য আরও নানাবিধ রচনার ন্যায় এই খেদোক্তিটিও কালজয়ী। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ফিরিয়া আসে। যেমন আসিল এই উৎসবান্তের মরসুমে। ক্রমে আলো কমিতেছে। দীপাবলীর রং (এবং শব্দ) ধীরে ফিকা হইল। এমনকী, জগদ্ধাত্রী পূজাও শেষ। সমস্ত প্রতিমা ভাসানে গিয়াছেন। জল হইতে উঠিয়া আসিতেছে খড়, কাঠামো, শোলার মুকুট। আজ, এই হেমন্তকালে, পৃথিবী অবশেষে ঈষৎ নীরব হইল। সেই নীরবতা যদি কোনও অবসর আঁকিয়া দেয়, সেই অবসরে বিরক্ত করিতে থাকে একটিই প্রশ্ন, মন কোথায় গেল? যে সকল উৎসবের পাত্রে মনটিকে ন্যস্ত ও ব্যস্ত রাখা হইয়াছিল, সে সকল আর নাই। কাজে ফিরিবার সময় হইয়াছে। কিন্তু, সেই নিত্যকার কাজ তো তেমন করিয়া বঙ্গজনের মন টানে না। নিত্যকর্ম তো অভ্যাসমাত্র, তাহা কি আর সৃষ্টিশীল (অ)কাজের সহচর হয়? সুতরাং, দৈনন্দিন কর্তব্যের কথা উঠিলে বঙ্গজনতা বিষম বিরক্ত। বরং, মনের খবর জানিতে চাহিলে দুই কলি গাহিয়া উঠিবেন, মন বলে আমি মনের কথা জানি না। কী করিয়াই বা জানা যাইবে? মনটি তো শুধুই জানালাপথে উধাও হয়, দূরে কোথাও...
সুখের কথা, উৎসব অন্তহীন। অসুখটি হইল, মাঝে মাঝে তাহাও ফুরায়। একটি উৎসব শেষ এবং আরও একটি শুরু হইবার মধ্যবর্তী কালের ভিতর কিছু পরিসর থাকে। তখনই বঙ্গমনে বিচিত্র শূন্যতা। একটি মোক্ষম দৃষ্টান্ত আই পি এল। মাসকাল ধরিয়া যে ক্রিকেট-কাণ্ড জনমনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, সেই কাণ্ডও এক সময় ফুরায়। সত্য, ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চক্ষে, কিন্তু এই দৃশ্য-শ্রাব্য সময়ে তো দৃশ্যভোজই একটি বৃহৎ আহার্য। অতএব, সেই আনন্দযজ্ঞ ফুরাইলে সহসা মনে হয়, এ জীবন লইয়া কী করিব? চক্ষের সমুখে ক্রিকেট নাই। বাহিরে আলোকমালা নাই। বিপণীতে ‘সেল সেল’ রব নাই। অতঃপর, কী-ই বা করণীয়? আমরা উৎসব করি, সুতরাং আমরা আছি, এমন মহাবাক্যে আস্থা রাখেন যাঁরা, তাঁহাদের সংখ্যা বড় কম নয়। সুতরাং, উৎসবের শেষ আলোকরশ্মি যাঁহাদের বিষণ্ণ করে, তাঁহারাও সংখ্যাগুরুর দলেই পড়িবেন। সেই বিরসবদন জনতা এক্ষণে প্রাণপণে ভাবিতেছে, আর কিছু না-ই হউক, সচিন তেন্ডুলকরের শততম শতরানটি এই সিরিজে আসিবে তো? তাহা হইলে অন্তত আরও একটি উৎসবের সুযোগ মিলিবে, আরও একটি প্রতিমায় মাল্যদানের অবসর আসিবে। এই বৎসরের ন্যায় অন্য সমস্ত উৎসবপ্রতিমা বিসর্জনে গিয়াছেন। বাকি একটিই, যাঁহাকে লইয়া উৎসব করা চলে। তিনিও নিরাশ করিলে বড় বিপদ। মন কোন কাজে নিরত থাকিবে? এই মুহূর্তে হেমন্তের বিষাদ গ্রামাঞ্চল তো বটেই, এমনকী মহানগরীকেও ধীরে গ্রাস করিতেছে। এই শূন্যতা মনকে অধিকার করে। কর্ণকুহরে আফিমখোর কিন্তু প্রখর বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন কমলাকান্ত চক্রবর্তী ফুকারিয়া উঠেন, মন কই? মন কোথায় গেল? |