নদিয়া জেলার ব্রহ্মশাসন গ্রাম থেকে ধাত্রীগ্রামে এসেছিলেন পণ্ডিত রামভদ্র তর্কসিদ্ধান্ত। টোল খুলে এই গ্রামেই তিনি শুরু করেছিলেন বিদ্যাচর্চা। তাঁর পরিবারের এক সদস্যকে স্বপ্নে রূপ দেখান দেবী জগদ্ধাত্রী। পরে স্নান করতে নেমে পুকুর ঘাটে জলভর্তি ঘড়ার মুখেও সেই একই রূপ প্রত্যক্ষ করেন তিনি। ধাত্রীগ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজোর সেই শুরু। পরে দেবীর নামেই এলাকার নাম হয় ধাত্রীগ্রাম। এলাকার প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস জানতে চাইলে ধাত্রীগ্রামের মানুষ গর্বের সঙ্গে এই গল্পই সামনে নিয়ে আসেন।
গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় প্রাথমিক স্কুল। স্কুলের দেওয়াল ঘেঁষে দেবীর কংক্রিটের মন্দির। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নবমীর দিন এখানে পুজো শুরু হয়। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো সারা হয় একই দিনে। প্রথা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন প্রতিমাশিল্পীর বাড়ি থেকে শোভাযাত্রা করে প্রতিমা নিয়ে আসা হয় মণ্ডপে। এর পরে দেবীকে পরানো হয় ডাকের সাজ এবং সোনার গয়না। পুজোর দিন সকাল থেকেই দেবীর কাছে মানত করতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন মন্দির প্রাঙ্গণে। তাঁদের জন্য মন্দির প্রাঙ্গণেই হয় ভোগ রান্না। এক এক জন মানতকারীর ভোগ রাখা হয় এক একটি মাটির সরায়। আলাদা করে প্রতিটি মাটির সরাই পুজোয় নিবেদন করেন পুরোহিত। পুজো কমিটির সদস্য শুভজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রতি বার প্রায় হাজার দেড়েক মাটির সরায় ভোগ রাখা হয়। যার নামে সরা থাকে, তাঁর নাম ও গোত্র ধরে পুজো করেন পুরোহিত।” |
প্রাচীন এই পুজোর বয়স নিয়ে অবশ্য রয়ে গিয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেন, তিনশো। কেউ সাড়ে তিনশো। কেউ বা তারও বেশি। তবে শুরু থেকেই এই পুজো সর্বজনীন। পুজো মন্দির থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে একটি ফাঁকা মাঠ। পুজো শুরুর দিন এই মাঠে বসে অন্নক্ষেত্র। এলাকা এবং বাইরের হাজার হাজার মানুষ এই অন্নক্ষেত্রে সামিল হন। অন্নক্ষেত্রের আসরে প্রায় ৬ কুইন্ট্যাল চাল ও ডাল রান্না হয়। বড় যাত্রার মঞ্চ বাঁধা হয় পুজো মন্দিরের সামনেই। অন্নক্ষেত্র শেষে সেই মঞ্চে শুরু হয় যাত্রা। পুজো কমিটির সঙ্গে যুক্ত গ্রামের বাসিন্দা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের কথায়, “অতীতে টানা এক সপ্তাহ ধরে যাত্রাপালা চলত। এখন অবশ্য তা কমে দাঁড়িয়েছে, এক দিনে।” হেমচন্দ্রবাবুর দাবি, পুজো উপলক্ষে যে অন্নক্ষেত্রের আসর বসে, তার চাল সংগ্রহ করা হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে। এছাড়া দেবীর ডাকের সাজ, ঢাক-সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী বিভিন্ন মানুষ পুজো কমিটির হাতে তুলে দেন। |
প্রাচীন এই পুজোয় রয়েছে পাঁঠা বলির রেওয়াজ। গ্রামবাসীরাই জানিয়েছেন, পুজোর বয়স যত বেড়েছে উৎসব উপলক্ষে জৌলুসও বেড়েছে তত। এ বার পুজো মন্দির থেকে এলাকার পোস্ট অফিস মোড় পর্যন্ত রঙিন আলোয় সাজানো হয়েছে। পুরনো পুজোয় দশমীতেও রয়েছে বিশেষ একটি রেওয়াজ। বিসর্জনের আগে গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিমার পাটাতন ধরেই ঘণ্টা দু’য়েক ধরে নাচানাচি করেন। এর পরে মন্দির থেকে কিছুটা দূরে গ্রামের এক পুকুরে প্রতিমার বিসর্জন পর্ব শেষ করা হয়। সেই পুকুরের নামও হয়ে গিয়েছে জগদ্ধাত্রী পুকুর। পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ রঞ্জনকুমার ভট্টাচার্যের কথায়, “বিসর্জনের ঠিক আড়াই দিন পরে জল থেকে তোলা হয় প্রতিমার পাটাতন।”
|