বছরের অন্য সময়ে সব কিছু ঠিকঠাকই থাকে। জগদ্ধাত্রী পুজো এলেই তাঁরা ‘আমরা-ওরা’। বর্ধমানের কাশিয়াড়া গ্রামের বাসিন্দাদের তখন একমাত্র পরিচয় তিনি উত্তরপাড়া না দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা।
প্রায় ৩০০ বছর ধরেই চলছে এই রেষারেষি। জমিদারি যখন ছিল, দুই পাড়ার প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে চলত লাঠি-সড়কি। মাথা ফাটত দু’পক্ষের লেঠেলদের। এখন অবশ্য গোলামালের আশঙ্কায় দুই পাড়ার বাসিন্দারা এক সঙ্গে প্রতিমা বিসর্জনে বের হন না।
গ্রামবাসীরা জানান, তিনশো বছর আগে এই পুজো নিয়েই দুই পাড়ার মাতব্বরদের মধ্যে গোলমাল বাঁধে। পুজোও পৃথক হয়ে যায়। সেই গোলমালের কারণ অবশ্য বলতে পারেননি প্রবীণেরাও। দুই পাড়ায় দেবী পূজিতা হন কৃষ্ণনগরের মতে। এক দিনেই হয়ে যায় সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো। কোনও পাড়াই আদি ঘরানা ছেড়ে বের হয়নি। তবে আজও রয়ে গিয়েছে রেষারেষিটা। শুক্রবার দু’পাড়ার সীমানায় দু’পক্ষের বাজনদারদের মধ্যে কে, কত জোরে বাজাতে পারেন, সে প্রতিযোগিতা ছিল স্পষ্ট।
উত্তরপাড়া জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির সদস্য সুদর্শন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা যদি ১০০ ফুটের প্যান্ডেল করি তাহলে ওরা ১১০ ফুটের প্যান্ডেল করে! আমরা ১০টা ঢাক আনলে ওরা আনে ১১টা। আমরা বনকাপাশি থেকে শোলার সাজ আনালে ওরা চলে যায় কলকাতার বাগবাজারে। সবসময়ই ওরা আমাদের থেকে এগিয়ে থাকতে চায়।” |
দক্ষিণপাড়ার পুজোর উদ্যোক্তা অলোক দে বলেন, “এ তো কিছুই নয়! জমিদারি আমলে টাকা পুড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা হত। মানে, এক পক্ষের জমিদার ১০ টাকা পোড়ালে, অন্য জমিদার পোড়াতেন ১০০ টাকা। সেই ধারাই ধরে রেখেছে দুই পাড়া। এখনও কোনও পাড়া একটা যাত্রা করলে অন্য পাড়া করে দু’টো।”
দু’পাড়ার পুজোর উদোক্তারাই অবশ্য তাঁদের পুজোর চমক গোপন রাখতে চান। যাতে শেষ মুহূর্তে অন্য পাড়া তাঁদের টেক্কা না দেয়। কিন্তু রয়েছে গুপ্তচরও। এই সময় আবার তাঁদের কদর যায় বেড়ে। মিষ্টি কথায় অথবা নানা উপহার দিয়ে চেষ্টা করতে হয় প্রতিপক্ষের খবর জানতে। আর সেই খবর ফাঁস হওয়া আটকাতে দুই পাড়ার প্রচেষ্টাও চোখে পড়ার মতো!
উত্তরপাড়ার উদয় দে, দক্ষিণপাড়ার কমল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দু’পাড়ায় প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। তাঁদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্কে বাধা পড়েছেন অনেকেই। তাই আমরা বা অন্য পাড়ার লোকেরা চেষ্টা করি আমাদের আত্মীয়দের কাছ থেকে এই খবরগুলো বের করতে। যদিও আমরাই আবার আমাদের লোকেদের ডেকে সতর্ক করে বলি, কে যে গুপ্তচর, বোঝা যাচ্ছে না। সাবধানে থাকো। আমাদের খবর যেন অন্যেরা না পায়।” সব মিলিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজো এলেই এখনও কাশিয়াড়া যেন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের আগে বাংলা। |