উঃ আহ্ আউচচচ
শ্বর নাকি ইভকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যথা অনুভূতির সৃষ্টি করেছিলেন। তাই অনেক দিন ধরেই ব্যথাকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে সহ্য করাই মানুষের কর্তব্য ছিল - এবং ব্যথা কমাবার কোনও উদ্যোগকে ঈশ্বরের বিরোধিতা করা হিসেবে ধরে নেওয়া হত।
তা হলেও বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে, ব্যথা কমাবার চেষ্টা থেমে থাকেনি। গ্রিস দেশে (২২৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে) ‘এসকুলাপিয়াস’ যন্ত্রণা কমানোর ‘ক্লে-ট্যাবলেট’ ব্যবহার করতেন। ইজিপ্টে (১৫৫০ খ্রি.পূ) আফিমের ব্যবহার, চিন দেশে আকুপাংচার, ভারতে শুশ্রুত (৮০০ খ্রি.পূ) ও চরকের (২০০ খ্রি) লেখাএ সব ক্ষেত্রেই নানা ভাবে ব্যথার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই দেখতে পাওয়া যায়।
তবে সপ্তদশ শতকের পর থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে ব্যথার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।
দেঁকার্তে (ফ্রান্স, ১৬৬৪) প্রথম বললেন, আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিদ্যুতের তারের মত নার্ভ বা স্নায়ু দিয়ে মেরুদণ্ডের ভেতর থাকা সুষুম্নাকাণ্ড এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত আছে। তাই শরীরে কোথাও চোট-আঘাত লাগলে, পুড়ে গেলেএই রাস্তা দিয়েই মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি পৌঁছলে আমরা ব্যথা টের পাই। এই যুগান্তকারী ধারণা আজও সর্বজনস্বীকৃত।
ক্রমে ক্রমে, ‘ব্যথা, কোনও রোগের উপসর্গ’ এমন একটা ধারণা আমাদের হল। ব্যথা কমাবার জন্য তাই রোগ বা চোট-আঘাতের চিকিৎসার দিকেই নজর পড়ল চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের।
আবিষ্কার হতে লাগল একের পর এক ব্যথা কমাবার অ্যানালজেসিক ওষুধ (অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন ইত্যাদি), যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যথা কমাতে সাহায্য করল। যদিও মুড়ি-মুড়কির মতো অতি ব্যবহারে পাকস্থলী, লিভার, কিডনির নানা ক্ষতিও হতে থাকল ভাল রকমই।
শল্যচিকিৎসকেরা জোর দিলেন শরীরের ত্রুটি মেরামত করবার ওপর। ছেঁড়া পেশি-ত্বক, ভাঙা হাড় মেরামতের নানা ব্যবস্থাও হল। অকেজো গলব্লাডার, বিগড়ে যাওয়া অ্যাপেনডিক্সকে কান ধরে বার করা হতে লাগলো পেটের ভেতর ব্যথা সৃষ্টি করার অপরাধে।
তবে গোল বাধল যেখানে যেখানে ব্যথা আছে, অথচ ব্যথার কারণ নেই বা অনেক দিন থাকার পরও কারো কারো আঙুলে, কব্জিতে বা গোড়ালিতে ভয়ঙ্কর ব্যথা হতে লাগলো! একে মানুষ ‘ভুতুড়ে ব্যথা’ বা ‘PHANTOM PAIN’ আখ্যা দিল। ওঝা-তান্ত্রিক-পুরোহিতে কাজ হল নাতাই এঁদের মানসিক রোগী ধরে নিয়ে চিকিৎসা হতে লাগলো।
তেমনই আরেক ব্যথা হল ‘ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া’(সম্প্রতি এক বলিউড অভিনেতার এই রোগ হওয়ার খবর অনেকেরই জানা)যেখানে হঠাৎ হঠাৎ মুখের এক দিক বা চোয়ালে তীব্র বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো যন্ত্রণা হয়।
‘হারপিস’ নামের গুটিবসন্তের ভাইরাসের এক আত্মীয় আছেন, তিনি আবার স্পাইনালকর্ড-এর নার্ভ-এর ভেতর বাসা তৈরি করে বছরের পর বছর ঘুমিয়ে থাকেন। হঠাৎ এক দিন ঘুম ভেঙে গেলেই শুরু হয় বুকে-পিঠে-হাতে-কোমরে, কোথাও না কোথাও তীব্র যন্ত্রণা। ‘পোস্ট হারপিটিক নিউরালজিয়া’ হল তার নাম!
কোনও রক্তপরীক্ষা, এক্স-রে, সিটি-স্ক্যান এমআরআই দিয়েই এ সব ক্ষেত্রে ব্যথার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
আবার মেরুদণ্ডে ‘ডিস্ক প্রোলাপ্স’-এও তীব্র ব্যথা হয় ঘাড়ে বা কোমরে, হাতে বা পায়ে, যা চলতেই থাকে। এমনকী বছরের পর বছর সাধারণ ব্যথার ওষুধে এ ব্যথা কমে না। অপারেশন করেও বেশির ভাগ সময়ই এ ব্যথার কোনও উপশম হয় না।
এই সব ক্ষেত্রে ব্যথার উৎপত্তি হল ব্যথা বয়ে নেওয়ারর কাজ যে স্নায়ুর , তার মধ্য থেকেই (সর্ষের মধ্যেই ভূত!)। স্নায়ুপথ বিকল হলে বা গন্ডগোল দেখা দিলে সেই স্নায়ুপথের দখলে থাকা এলাকায় কোনও গন্ডগোল না হলেও ব্যথা হয় সেই এলাকাতেই! এই ধরনের ব্যথা সহজে কমে না। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ-মাস-বছর-চলতেই থাকে এই ব্যথা। এরই নাম ‘ক্রনিক পেন’।
তাই ‘ক্রনিক পেন’ আর কেবল একটি রোগের উপসর্গ নয়, যা আলাদা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। ঠিক ভাবে ‘ক্রনিক পেন’-এর চিকিৎসা না হলে ডায়বেটিস, রক্তচাপ বেড়ে যায়। হার্টের ক্ষতি, অবসাদ এগুলো দেখা যায়।
এই ‘ক্রনিক পেন’ রোগের চিকিৎসার পদ্ধতিও আলাদা, সেখানে অ্যানালজেসিক-এর জারিজুরি চলে না। অ্যালগোলজিস্ট (ALGOLOGIST) বা ব্যথা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে স্নায়ুপথে ব্যথার চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার ওষুধ ছাড়াও আধুনিক C-arm (এক ধরনের এক্স-রে যন্ত্র), সিটি-স্ক্যান, এ সবের সাহায্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নির্ভুল ভাবে ব্যথা সংবহনের স্নায়ুপথটিকে চিহ্নিত করে এক ধরনের বেতার তরঙ্গের (Radio-frequency-wave) মাধ্যমে, সেই স্নায়ুপথে বেশি ব্যথার অনুভূতি যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আজ মানুষের আয়ত্তে।
১৯৬৫ সালে মেলজ্যাক সাহেব বললেন,‘ব্যথার অনুভূতির সঙ্গে অন্য অনুভুতিগুলো আলাদা আলাদা রাস্তা দিয়ে স্পাইনাল কর্ডে যখন ঢোকে, তা অনেকটা প্ল্যাটফর্মে ঢোকা রেলগাড়ির মতো। যদি কেউ গেটম্যান হিসেবে ব্যথার রেলগাড়িগুলোকে না ঢুকতে দিয়ে স্পর্শ, সুড়সুড়ির মতো আরামদায়ক অনুভূতিকে ঢুকতে সাহায্য করে তা হলে ব্যথাকে এক হাত নেওয়া যায়!’ এই বিখ্যাত গেট কন্ট্রোল থিয়োরি’কে কাজে লাগিয়ে আধুনিক স্পাইনাল কর্ড স্টিমুলেটর আবিষ্কার হচ্ছে, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যথার রোগগুলোকে জব্দ করে দিয়েছে। এই সব চিকিৎসা ছাড়াও ঠিক পদ্ধতিতে ব্যায়াম, ফিজিয়োথেরাপি, এবং বিশেষজ্ঞের মত নিয়ে যোগব্যায়াম, ধ্যান ও প্রাণায়াম অনেক সময় খুব কার্যকারী হয়।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই আমাদের দেশে এমনকী আমাদের রাজ্যেও এই পেন-ম্যানেজমেন্ট চিকিৎসা একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘ক্রনিক পেন’-এর চিকিৎসার কালোরাত্রির আকাশে একটি-দু’টি তারার মতো ফুটতে শুরু করেছে।

ক্রনিক পেন কোনগুলি?
রোগ সেরে যাওয়ার পরও যে ব্যথা থাকে। কোনও ক্ষত, চোট-আঘাত না থাকলেও যে ব্যথা হতে থাকে। পনেরো দিনেরও বেশি ব্যথা যদি চলতে থাকে। মাইগ্রেন, কোনও ধরনের নিউরালজিয়া, এগুলোও ক্রনিক পেন হতে পারে। ক্যান্সারের ব্যথাও এই শ্রেণিতে পড়ে।
ক্রনিক পেন কি সাধারণ ব্যথার থেকে আলাদা?
সাধারণ ব্যথা (অ্যাকিউট পেন) রোগের উপসর্গ। ক্রনিক পেন নিজেই একটা রোগ। সাধারণ ব্যথার কোনও কারণ থাকে। সেই সব কারণ (মচকানো, চোট-আঘাত, সংক্রমণ থেকে প্রদাহ) সারালে সাধারণ ব্যথা সেরে যাবে।
কিন্তু কারণ সারলেও, বা আপাতদৃষ্টিতে কোনও কারণ না থাকলেও ক্রনিক পেন চলতে থাকে। ক্রনিক পেন-এর কারণ এক্স রে, এম আর আই, বা রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে না।

ক্রনিক পেন-এর চিকিৎসা আলাদা কেন?
সমস্যা যেহেতু স্নায়ুতন্ত্রে, তাই সেই ওষুধ দেওয়া উচিত যা স্নায়ুপথে ব্যথার সংবহন কমিয়ে দিতে পারে। সাধারণ ব্যথার ওষুধে তা হয় না।

পেন কিলার খেলে কাজ হয় না কেন?
ক্রনিক পেন-এর ক্ষেত্রে ব্যথার কারণ প্রদাহ নয়। তাই পেন কিলার কাজ করবে না। বরং পেন কিলারের সাইড এফেক্ট দেখা দেবে। স্টমাক, কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ব্যথা কি তবে মনে?
অনেক সময়ে ব্যথার কোনও কারণ খুঁজে না পেয়ে ডাক্তাররা সাইকায়াট্রিস্ট-এর কাছে ক্রনিক পেনের রোগীদের পাঠান। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা মনের নয়, স্নায়ুর। ঠিক চিকিৎসায় ব্যথা সেরে যেতে পারে।
তবে যারা দীর্ঘদিন ক্রনিক পেন-এ ভোগেন তাঁরা অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসা কাজে দিতে পারে।

ক্রনিক পেনের চিকিৎসা কী?
প্রাথমিক ভাবে প্যারাসিটামল বা Tramadol জাতীয় ওষুধ দেওয়া যায়, অন্য কোনও পেন কিলার (Ibuprofen) দেওয়া যাবে না। তাতে না কমলে Pregabalin জাতীয় ওষুধ যা ব্যথার সংবহনকে কমিয়ে দেয়, অথবা Amitryptiline জাতীয় ওষুধ, যা শরীরের নিজস্ব ব্যথা কমাবার রাসায়নিক পদার্থকে বেশিক্ষণ স্নায়ুতন্ত্রে রাখতে সাহায্য করে, তা কাজ করতে পারে।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসারে যোগ, প্রাণায়াম করলে কাজ হয়। কাজ না হলে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে (ফ্লুরোস্কোপ)-এর সাহায্যে ব্যথা যাওয়ার স্নায়ুপথটিকে চিহ্নিত করে ব্যথার সংবহন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। এখন কিন্তু ক্যান্সারর যে কোনও স্তরের রোগীরা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.