অ মা! তুই মরেই গেলি?
কালীপুজোর ক’টা দিন আমাদের বাড়ির সামনের ডগেশ্বর আর তার স্যাঙাতরা বেজায় ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। সে কী দুমদাম আওয়াজ সারা ক্ষণ। এমনিতে তাদের খুব দাপট। রাতে কেউ দেরি করে বাড়ি ফিরলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে, কোনও বাইক দেখলে হঠাৎ তেড়ে যাবে, আর-জন্মের কোনও রাগের কারণে হয়তো বা। কিন্তু এ ক’দিন সব কুঁই কুঁই। হ্যারাসমেন্ট এখানেই শেষ নয়। এদেরই কারও ল্যাজে কালীপটকার মালা বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেবে ‘উল্লাসী সব পাবলিক’, কুকুরের ছটফটানিতে খুঁজে নেবে পৈশাচিক আনন্দ।
অথচ এই একটা জাত যারা কোনও প্রত্যাশা না করে ভালবাসতে পারে। এক বেলা খেতে দিলে রোজ এসে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকে। এক-দু’বার খেললে তো কথাই নেই একেবারে চিরবিশ্বস্ত। পোষা হলে তো আরও মজা। অফিস থেকে ফেরার পরেই বল নিয়ে খেলতে চলে আসবে, ভোরবেলা মুখে করে কাগজ এনে দেবে, বাড়ির ছোট্টটি কান ধরে মুলে দিলেও কিচ্ছুটি বলবে না। বুদ্ধি এমনই যে মানুষের সব কথা বোধ হয় বুঝতে অবধি পারে। কার মন খারাপ, কে রেগে রয়েছে, সব। কেবল কথাটাই যা বলতে পারে না। আর সেটাই ওদের সবচেয়ে বড় বিপদ। কবে যে কার মন উঠে যাবে ওদের থেকে, তখন হঠাৎই হয়ে উঠবে বোঝা। কে বদলির চাকরিতে অন্যত্র চলে যাবে, ডগারামকে তখন অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া হবে। ডগার শরীর খারাপ অথচ বাড়িতে বাচ্চা আছে, আগেভাগে ডগাকে সরিয়ে দাও। বেচারাকে কেউ জিজ্ঞেস অবধি করবে না, ওর এতে মত আছে কি না, ওর অন্যত্র যেতে ইচ্ছে করছে কি না।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
ঠিক যেমনটা হয়েছিল লাইকা’র বেলায়। স্পুটনিক-২ মহাকাশযানের সঙ্গে মহাশূন্যে উড়ে গিয়েছিল লাইকা। পৃথিবীবিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট-এর খাতিরে। সবচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট কুকুর ছিল সে। কারও সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করত না, ল্যাজ নেড়ে সদাই খুশ। অতএব দলের মধ্যে তাকে বেছে নেওয়া হল ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না। ট্রেনিং-এর সময় বাধ্য ছেলের মতো সবটুকু সে মন দিয়ে করেছে। এমনকী স্পুটনিক-২ ছাড়ার তিন দিন আগে তাকে স্পেসক্রাফ্ট-এ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে টুঁ অবধি করেনি। তার পর আগুনের ঝাপটা ঝেড়ে ওপরে উঠেছিল স্পুটনিক। সে-ও ফেরেনি আর লাইকা-ও ফেরেনি। যখন স্পুটনিক-২ ছাড়া হয়েছিল তখনই বিজ্ঞানীরা জানতেন ওটি আর ফিরছে না। আহা, লাইকার কী মনে হচ্ছিল তখন? ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছিল, ও কি ভাবছিল বিশ্বাসঘাতক লোকগুলোর কথা। ওর কি মনে পড়ছিল পার্কের সবুজ গালিচায় লাল বলের তুড়ুক নাচন? কেউ জানতে চায়নি। স্পুটনিক ছাড়ার চার ঘন্টা পর থেকে লাইকার আর কোনও রেসপন্স পাওয়া যায়নি। কেউ বলে অক্সিজেনের অভাবে, কেউ বলে চেম্বারটা অত্যধিক গরম হয়ে গিয়েছিল, তাই লাইকা মারা যায়।
লাইকার মারা যাওয়া নিয়ে অবশ্য অনেক মত আছে। কেউ বলে চার ঘন্টা পর মারা গিয়েছিল, কেউ বলে দশ দিন পর। এ সব তথ্য তখন কিন্তু জানা যায়নি। এই নিয়ে মুখ খুললে সটান শূলে চড়িয়ে দেবে কমিউনিস্ট সরকার। ১৯৯৮ সালে স্পুটনিক-২ বিজ্ঞানীদলের এক জন ভারী দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রকাশ্যে স্বীকার করেন একটি প্রাণীকে এ ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। বিজ্ঞানী ওলেগ গাজেঙ্কো, যিনি কিনা লাইকাকে বেছে নিয়েছিলেন ফাইনাল কাউন্টডাউনে,তাঁর কষ্ট একটু বাড়তি। একে তো নিজে হাতে মৃত্যু-চেম্বারে লাইকাকে বসিয়েছিলেন আবার ও দিকে যে জ্ঞান নিংড়ে নেওয়ার জন্য লাইকার জীবন বলি দেওয়া হল সেই কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানের ভাণ্ডার ডেটা-সমৃদ্ধ করতে পারল না লাইকা।
এই ঘটনায়, জীবজন্তু ভালবাসেন এমন কিছু মানুষ প্রতিবাদ করেন। ব্রিটেনে ন্যাশনাল কেনাইন ডিফেন্স লিগ সমস্ত কুকুর-মালিকদের লাইকার জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করতে বলে। ক্রুশ্চেভ মিশনের সাফল্য ঘোষণা করার আগে থেকেই রয়াল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস সংস্থার কাছে প্রচুর প্রতিবাদ জমা হয়। নানা জায়গায় অ্যানিম্যাল রাইটস গ্রুপগুলি বিক্ষোভ জানায়।
তাতে কী? সোভিয়েত ইউনিয়ন তো দেশের স্বার্থে মাত্র একটা কুকুরকে বলি দিয়েছে। ওদের ভাবধারাই তো চাই। যাতে সবার ভাল, তা-ই করতেই হবে। তাড়াহুড়ো করে স্পুটনিক-২ ছাড়ায় রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কী লাভ হয়েছিল জানি না, কিন্তু ক্রুশ্চেভের ইগো ফেঁপেফুলে টইটম্বুর হয়েছিল। এতে তো দেশের মানুষের আনন্দিত হওয়ারই কথা। অথচ ছাড়ার সময়েই তো জানা ছিল স্পুটনিক-২ আর লাইকা কেউই ফিরছে না ফিরবে না। অতএব সুপরিকল্পিত ভাবে একটা প্রাণীকে মরতে হবে, এটা ধ্রুব। বাকিটা কেবল ফর্ম্যালিটি। এটাকে বোধ হয় কোল্ড-ব্লাডেড মার্ডার বলে। রাজনীতির আবশ্যিক শর্ত।
মা-বাবার কাছে শুনেছি, সেই সময় অনেকে নাকি রাতের তারা-ভরা আকাশে স্পুটনিককে চলে যেতে দেখেছে।
আর কালপুরুষের পায়ের কাছে যে, সে তো লাইকা। তাই না?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.