|
|
|
|
‘লাইকা’ ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই |
১৯৫৭’র ৩ নভেম্বর লাইকা কুকুরকে নিয়ে স্পুটনিক-২
মহাকাশে উড়েছিল। লাইকা ফিরে আসেনি। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
১৯৫৭, মস্কো। অক্টোবরের বেশ সকাল। হাঁ করলেই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, এমন শীত। দোকানপাট ইতিউতি খুলছে, ভোরের শিশির ধরছে জানলা দিয়ে বের করা একটা ফরসা হাত, আধ-ঘুমন্ত বাচ্চাকে পাঁজাকোলা করে স্কুল দিয়ে আসছে বাবা, এক বৃদ্ধ রুটিন মেনে ‘ইজরায়েল আবার কী দেশ?’ বলে আশপাশের সব্বাইকে বিরক্ত করে মারছেন, রাস্তার কুকুর’রা ছুঁড়ে দেওয়া একটা পাউরুটি নিয়ে বেধড়ক ক্যাইম্যাই বাধিয়ে তুলেছে, আর...
ক্যাঁচ করে এসে থামল একটা বড় গাড়ি। দাঁড়ানো দেখেই কেমন যেন ভয় করে। দরজা খুলে নেমে এল চার-পাঁচ জন উর্দি পরা লোক। পলক ফেলার আগেই ওঁরা চার-পাঁচটা কুকুরকে ধরে ফেলল একটা লম্বা জাল দিয়ে। তখনই দেখা গেল গাড়ির পিছনে একটা মাঝারি সাইজের খাঁচা রয়েছে। গাড়ি আওয়াজ করে চলে যেতেই কিছু কুকুর পিছনে দৌড় লাগাল আর বাকিরা ফের পাউরুটিতে মন বসালো। মোড় ঘুরে অদৃশ্য হওয়ার আগে, ভেতরের একটা কুকুর খাঁচায় মুখ ঠেকিয়ে কী যেন বলতে চাইছিল বাকিদের...
গাড়িটা শেষে এয়ার ফোর্স ইনস্টিটিউট অব এভিয়েশন মেডিসিন-এর সামনে এসে দাঁড়াল। কুকুরগুলোকে নামিয়ে যখন ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনই ওরা শুনল পরিচিত অন্য কিছু কুকুরের ডাক। তত ক্ষণে এদের বেশ খুঁটিয়ে দেখছে ইনস্টিটিউটের কিছু অফিসার। দেখতে তো হবেই, রাষ্ট্রনায়কের হুকুম বলে কথা!রাষ্ট্রনায়কের হুকুম মানে? আরে সে বিরাট ব্যাপার। নিকিতা ক্রুশচেভ সবে এক দান জিতেছেন। ৪ অক্টোবর স্পুটনিক ১ সমস্ত মার্কিন সাধ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ ছুঁয়ে ফেলেছিল। ফলে ‘স্পেস রেস’-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন -১, আমেরিকা - ০। বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন দুই মহাশক্তি এই ভাবেই তো ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছিল। স্পুটনিক ১-এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তিনি ঠিক করলেন, স্পুটনিক ২ উড়বে। মহাকাশে। আরও জাঁকজমক করে, আরও সাড়া ফেলে। সামনে তো আবার নভেম্বর বিপ্লবের উদযাপন, সে দিনই নয় আকাশ জুড়ে একটা উৎসব হোক! কিন্তু সময় যে অবিশ্বাস্য রকম কম?
তো? নাগাড়ে বাতিল হল অফিসারদের ছুটি, ভোর কখন হয় রাত কখন হয় খেয়ালই নেই কারও, সবার শিড়ায় শুধুই যন্ত্রচালিত শাসন। এরই মধ্যে ওলেগ গাজেঙ্কো পেলেন এক অন্য কাজ। তাঁকে বলা হল, কুকুরগুলোকে শিখিয়ে পড়িয়ে উড়ানের জন্যে তৈরি করতে। ওদের দিয়েই তো বুঝতে হবে, মানুষকে মহাকাশে যেতে হলে কী কী মোকাবিলা করতে হবে। ওলেগ লেগে পড়লেন কাজে। প্রথমেই ওঁর চোখ টানল একটি শান্ত গোছের কুকুর। একে আমরা চিনি। সেই যে খাঁচায় মুখ ঠেকিয়ে দেখেছিল...মনে পড়ছে? বয়স তিনের মতো, ওজন পাঁচ কেজি, মিশ্র প্রজাতির মেয়ে কুকুর ছিল কুদ্রিয়াভকা। এটা ছিল ওর একটা নাম। ভালবেসে অনেকে ঝুচকা (ছোট্ট পোকা) বা লিমনচিক-ও (ছোট্ট লেবু) ডাকত। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ও বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেল লাইকা নামে। ওলেগ সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে গিয়ে দেখলেন, লাইকা অন্যদের মতো খেঁকিয়ে উঠে ঝগড়া করে না, যখন তখন বেড়া টপকে পালোনোর চেষ্টা করে না, বেয়াড়া হয়ে কামড়ে দিতে আসে না আর সব চেয়ে বড় কথা, খুব খুব বাধ্য। যেন মানুষের হাতের খেলনা হতেই ওর জন্ম।
স্পুটনিক-এর জন্যে বেছে নেওয়া হল তিন জনকে। অ্যালবিনা, মুশকা আর লাইকা। অ্যালবিনা এর আগেও সোভিয়েত টেস্ট রকেটে চড়েছে, কিন্তু মহাকাশের অনন্ত শূন্যে কোনও দিন ভাসেনি। ওদের টানা কিছু দিন খুব ছোট্ট একটা খাঁচায় রাখা হল। স্পুটনিক-এ আর কতটাই বা জায়গা? খাঁচা এমন ছোট ছিল যে মল বা মূত্রত্যাগ করাও প্রায় অসম্ভব। হলও তাই। দিনকে দিন শরীর বিগড়োতে লাগল, ওরা অস্থির হয়ে উঠল। ডাক্তার যতই ওষুধ দেন, লাভ হয় না। কিন্তু স্পুটনিককে যে উড়তেই হবে, এবং একটি কুকুর নিয়েই, তাই বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন, আরও অধ্যবসায় চাই। কুকুরদের। অতএব ওই খাঁচাতেই থাকতে হবে, আরও লম্বা সময় ধরে। ধীরে ধীরে সয়ে যাবে। সত্যি সয়ে গেলও-ও।
মাঝে মাঝে ওরা ওই খাঁচা থেকে ছাড় পেত যদিও। তখন ওদের রাখা হত একটা ক্যাপসুলের ভেতর, যাতে চড়লে মনে হবে, আপনি রকেটে চড়ছেন। আর সঙ্গে সেই কান ফাটানো আওয়াজও। এ সবের ফলে ওদের পাল্স রেট বেড়ে যেত দ্বিগুণ আর রক্তচাপও প্রায় ফেটে পড়ার জোগাড়। কিন্তু এই প্র্যাক্টিস না করলে আকাশে গিয়ে কী হবে, শুনি? আর তা ছাড়া ক্যাপসুল থেকে বেরোনোর কিছু ঘন্টা বাদেই তো সব আবার স্বাভাবিক। এত হল্লার কী যে আছে?
যাক গে, মাহেন্দ্র ক্ষণ এগিয়ে এল। লাইকাকে বাছা হল ইতিহাস সৃষ্টির জন্যে। ঠিক হল স্পুটনিক উড়বে ৩ নভেম্বর। তার তিন দিন আগেই লাইকাকে এই কৃত্রিম উপগ্রহের ভেতর চালান করে দেওয়া হল। তার আগে অবশ্য ওলেগ গাজেঙ্কো ওকে এক বার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, ওঁর বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে। আসলে ওলেগ চেয়েছিলেন যাওয়ার আগে যদি লাইকাকে একটু আনন্দ দেওয়া যায়। কারণ ও তো আর ফিরবে না। ক্রুশচেভ-এর তাড়াহুড়োর চোটে যে মহাকাশযান তৈরি হল, সেটিকে ফিরিয়ে আনার কোনও ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে...
বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে স্পুটনিক উড়ে গেল লাইকাকে নিয়ে। ইতিহাস ইতিহাস। লাইকা’র গায়ে লাগানো সেন্সর থেকে জানা যায়, উড়ে যাওয়ার মুহূর্তে ওর নিশ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গিয়েছিল চারগুণ। হৃৎস্পন্দন ১০৩ বিট প্রতি মিনিট থেকে এক লাফে পৌঁছেছিল ২৪০ বিট প্রতি মিনিট। সেই সময়ের সোভিয়েত সরকার জানিয়েছিল লাইকাকে দিন দশ পরই খাবারে বিশ মিশিয়ে ‘পেনলেস ডেথ’ দেওয়া হবে। কিন্তু আজ আমরা জানি, লাইকা উড়ানের পাঁচ-সাত ঘন্টা পরই স্ট্রেস এবং অস্বাভাবিক গরমের চোটে মারা যায়। লাইকা’র নিথর দেহ নিয়ে স্পুটনিক উড়ে চলে আরও পাঁচ মাস। তার পর এক দিন সেও আছড়ে পড়ে পৃথিবীতে। আর লাইকা’র স্মৃতিটুকু লেগে রইল তারাদের ফাঁকে। সরি, লাইকা... |
|
|
|
|
|