সারা জীবন কি অন্যের উপরে নির্ভর করে কাটাতে হবে তাঁকে?
এই প্রশ্নের জবাব না-পেয়ে হতাশ ২৩ বছরের রাজীব গুপ্ত।
রাতে কলকাতার রাস্তায় মোটবাইক চালাচ্ছিলেন রাজীব। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল বন্ধুদের খানচারেক মোটরসাইকেল। আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাতিস্তম্ভের সঙ্গে ধাক্কা মারে মোটরবাইক। ছিটকে পড়েন রাজীব। মেরুদণ্ডের কিছুটা অংশ প্রচণ্ড আঘাতে ভেঙে যায়। একাধিক অস্ত্রোপচারের পরে রাজীব বেঁচে আছেন। কিন্তু পঙ্গু হয়ে। হুইলচেয়ারে। কোমরের নীচ থেকে অসাড়। রাজীব এখন একা জামাকাপড় পরতে পারেন না। করতে পারেন না অন্য অনেক কাজও।
শুক্রবার শিরদাঁড়ার আঘাত সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় এসে রাজীব জানলেন, তিনি একা নন। রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পরে পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর ১৬০০ মানুষ কোনও না কোনও ভাবে মেরুদণ্ডের আঘাতের শিকার হচ্ছেন। দিল্লির ইন্ডিয়ান স্পাইনাল ইনজুরি সেন্টার দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে যে-রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতেই জানানো হয়েছে এ কথা। রাজীবের মতো অসংখ্যা মানুষকে শিরদাঁড়ায় অস্ত্রোপচারের পরে বাকি জীবনটা অন্যের বোঝা হয়ে কাটাতে হচ্ছে। কারণ, সরকারি পর্যায়ের কোনও হাসপাতালে তাঁদের পঙ্গু অবস্থায় স্বনির্ভর হয়ে বাঁচার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও।
এ দিনের সম্মেলনে রাজীবদের পুনর্বাসন এবং সরকারি স্তরে প্রশিক্ষণের দাবি উঠল। দাবি উঠল যথাযথ চিকিৎসারও। রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের মধ্যে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে মেরুদণ্ডের আঘাতের রোগীদের জন্য আলাদা ১০টি শয্যা রয়েছে। পূর্ব ভারতে সরকারি হাসপাতালে ২০০টিরও কম শয্যা আলাদা করে মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য বরাদ্দ। অস্থিচিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটকের উপলব্ধি, “যে-কোনও মুহূর্তে যে-কারও জীবনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তা সত্ত্বেও এই চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। প্রশিক্ষণেরও তেমন ব্যবস্থা নেই।”
ভারতে মেরুদণ্ডের আঘাতে যাঁরা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে! ইন্ডিয়ান স্পাইনাল ইনজুরি সেন্টারের ডিরেক্টর জেনারেল আশিসকুমার মুখোপাধ্যায় বললেন, “দেশের কর্মক্ষম অংশের একটা বড় অংশ এই ভাবে অচল হয়ে যাচ্ছে।” আশিসবাবুদের আক্ষেপ, অস্ত্রোপচারের পরেও সরকারি স্তরে ওই যুবকদের কর্মক্ষম রাখার কোনও ব্যবস্থা করা গেল না! নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারির প্রধান পরিমল ত্রিপাঠী এ ব্যাপারে তাঁদের অসহায়তার কথা গোপন করেননি। বলেছেন, “অস্ত্রোপচারের পরে রোগী একটু সুস্থ হলে তাঁকে বাড়ি পাঠানো ছাড়া আর কোনও সাহায্যই করা যায় না।”
রাজ্যে নিউরোলজি সংক্রান্ত চিকিৎসার বিশেষজ্ঞ কেন্দ্র বাঙুর ইনস্টিটিউটেও মেরুদণ্ডের আঘাতে পঙ্গু রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। সেখানকার সার্জারির প্রধান সমরেন্দ্র ঘোষ বলেন, “এই ধরনের অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে রোগীর কিছু বিশেষ যত্ন ও প্রশিক্ষণ দরকার। হঠাৎই পঙ্গুত্বের কবলে পড়া রোগী কী ভাবে যাতায়াত করবেন, কেমন করে পোশাক পরবেন, খাবেন, শৌচাগারে যাবেন, বেডশোর এড়াবেন সব কিছুই শেখানো দরকার। সরকারি হাসপাতালের চলতি ব্যবস্থায় যা অসম্ভব।”
মাস পাঁচেক আগে স্বাস্থ্য দফতর ঘোষণা করেছিল, কলকাতায় সরকারি স্তরে একটি অর্থোপেডিক হাসপাতাল কিছু দিনের মধ্যে চালু হবে। তার কী হল? এ দিনের সম্মলনে সেই প্রশ্নও উঠল। স্বাস্থ্য অধিকর্তা শ্যামাপদ বসাকও জানেন না, ওই হাসপাতালের কী ভবিষ্যৎ। তাঁর মন্তব্য, “একটা প্রসঙ্গ উঠেছিল। তার পরে কী হল, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।” |