শিশুমৃত্যুর ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। শোরগোলও পড়ছে।
কিন্তু কী ভাবে, কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, এবং ঠিক কী কারণে শিশুটি মারা গেল, সেটা সব ক্ষেত্রে পরিষ্কার হচ্ছে কি?
এই সব তথ্য-সূত্রে যাতে কোনও ফাঁক না-থাকে, সেই লক্ষ্যে এ বার সমস্ত সরকারি হাসপাতালে প্রতিটি শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ‘ডেথ অডিট’ চালু করতে চলেছে রাজ্য সরকার। ডেথ অডিট ব্যাপারটা কী?
কোনও সংস্থার আয়-ব্যয়ের হিসেবে গরমিল ধরতে যেমন অডিট হয়, তেমন কোনও শিশুর মৃত্যু কেন হল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তই হল ‘ডেথ অডিট।’ এতে দেখা হয়, হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত শিশুটির কী ভাবে চিকিৎসা হয়েছিল, তাকে অন্য জায়গা থেকে ‘রেফার’ করা হয়েছিল কি না, কোন কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন, কী কী ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, নার্সরা সেই সব ওষুধ ঠিকঠাক খাইয়েছিলেন কি না ইত্যাদি। শিশুমৃত্যু কমাতে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার পরীক্ষামূলক ভাবে সরকারি হাসপাতালে এমন তদন্ত বা ‘অডিট’ চালু করেছিল বটে, কিন্তু কোথাওই তা পুরোপুরি মানা হয়নি।
রাজ্যের নতুন সরকার এখন এ দিকে নজর দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিটি শিশুমৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত ও যথাযথ তথ্য দফতরের হাতে মজুত থাকুক। সেই মতো এ বার ‘ডেথ অডিট’ সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশিকা জারি হচ্ছে স্বাস্থ্যভবন থেকে।
সম্প্রতি কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতাল এবং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পরের পর শিশুমৃত্যুতে সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। যার মোকাবিলায় পরিকাঠামোর হাল নিয়ে পূর্বতন সরকারকে দোষারোপের পাশাপাশি শিশুমৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব-ব্যবস্থা (অডিট) বাধ্যতামূলক করতে চলেছে স্বাস্থ্য দফতর। শুক্রবার রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে যে সব পদক্ষেপ করা হচ্ছে, এটি তার অন্যতম। তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের কিছু জায়গায় ইতিমধ্যে এর মাধ্যমে সুফলও মিলেছে বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি।
সরকারি হাসপাতালের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে মানুষের অভিযোগের অবশ্য অন্ত নেই। এবং স্বাস্থ্য-কর্তারা মোটামুটি একমত যে, আগের জমানায় এক শ্রেণির চিকিৎসক ও অন্য সরকারি কর্মীদের সদিচ্ছার অভাবেই ‘ডেথ অডিট’ বা ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট’ আইনের বহু নির্দেশিকা মানা যায়নি। সঙ্গে ছিল পরিকাঠামোর অভাব। দু’টো সমস্যাই কিন্তু রয়ে গিয়েছে। এর দাওয়াই কী?
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে নজর রাখতে এ বার হাসপাতালের অধ্যক্ষদের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। এ দিন স্বাস্থ্যভবনে বিভিন্ন হাসপাতালের অধ্যক্ষদের বৈঠকে ডেকে ‘দায়বদ্ধতা’ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা। বস্তুত স্বাস্থ্যভবনের নির্দেশ, শিশুর ডেথ অডিট তৈরিতে অধ্যক্ষদেরই উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি ঘোষণা হয়েছে, আগামী মার্চের মধ্যে ৪০টি সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) তৈরি হবে রাজ্য। কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব?
প্রশ্নটি এ দিনও উঠেছে। গত জুলাইয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে রাজ্যে ২৩টি এসএনসিইউ চালু হবে। অথচ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এসে দেখা যাচ্ছে কলকাতার বিসি রায় ছাড়া কোথাও তা চালু হয়নি। কারণ, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাব। এই যখন অবস্থা, তখন আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে চল্লিশটা এসএনসিইউ কী ভাবে গড়ে উঠবে, তার কোনও ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য-কর্তারা দিতে পারেননি।
তবে প্রসূতি ও নবজাতকের চিকিৎসায় রাজ্য সরকার আরও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে স্বাস্থ্য-সচিব এ দিন জানিয়েছেন। যেমন?
সঞ্জয়বাবু বলেন, পশ্চিমবঙ্গে এখন ৯৭টি ‘নিউবর্ন স্টেবিলাইজেশন ইউনিট’ রয়েছে। আরও ২৩৪টি তৈরি হচ্ছে। জন্মের পরে রুগ্ণ শিশুকে খানিকটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে এগুলো কাজে লাগে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তরে ১০৩টি ‘নিউবর্ন কেয়ার কর্নার’ রয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আরও ৪৭৯টি চালু হবে। জেলায় জেলায় চালু হবে ‘ইমার্জেন্সি মেটারনিটি অবজার্ভেশন কেয়ার।’ যে প্রসূতিরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পৌঁছতে পারবেন না, তাঁদের জন্য বাড়িতেই ‘হোম বেসড নিওনেটাল কেয়ার’-এর ব্যবস্থা হবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য-কর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁদের শেখাবেন সন্তান পরিচর্যার বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন পদ্ধতি।
কিন্তু এখানেও দু’টো নির্দিষ্ট প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা।
প্রথমত, এত চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী মিলবে কোথায়? দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সরকারি দফতরে সমন্বয়ের যা হাল, তাতে নির্দিষ্ট সময়ে ‘বিশেষ’ ওই সব ওয়ার্ড তৈরি করা যাবে কি? স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশও মানছেন, এই সব সমস্যার কারণেই এসএনসিইউগুলো সময়ে তৈরি হতে পারেনি। সরকারের কী বক্তব্য?
স্বাস্থ্য-সচিবের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “সময়সীমা মেনেই সব কিছু হয়ে যাবে।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এসএনসিইউগুলোয় চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা হচ্ছে।”
সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যক্টিসের প্রসঙ্গও উঠেছে এ দিনের বৈঠকে। অভিযোগ উঠেছে, বিসি রায়ের কিছু চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে বেশি মন দিচ্ছেন। সচিব বলেন, “কাজে ফাঁকি দেওয়া বরদাস্ত করা হবে না। স্পষ্ট জানাচ্ছি, কোনও চিকিৎসক সরকারি কাজে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করলে সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপের কথা ভাবা হবে।”
সে ক্ষেত্রে কি সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের অনুমতি নিয়েও নতুন করে ভাবনাচিন্তা হবে? স্বাস্থ্য-সচিব অবশ্য প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছেন।
এ দিকে সরকারি হাসপাতালে সকাল সওয়া ন’টায় আউটডোর চালুর সিদ্ধান্ত হলেও বহু হাসপাতালে তার মধ্যে চিকিৎসকেরা হাজির হচ্ছেন না। স্বাস্থ্য-কর্তারা কবুল করছেন, এসএমএস-ব্যবস্থাতেও বিস্তর ফাঁক। সচিবের কথায়, “অনেকেই এসএমএসে ঠিক তথ্য পাঠাচ্ছেন না। অনেকে আবার যে পদ্ধতিতে পাঠানোর কথা, সে ভাবে পাঠাচ্ছেন না। সবে দু’মাস চালু হয়েছে। তাই এখনও নানা ত্রুটি আছে। দ্রুত শুধরে নেওয়া হবে।” আর এ সব বিষয়ে হাসপাতাল প্রধানদেরও যে পুর্ণ দায়বদ্ধতা রয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিতে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের নিয়ে এ দিন বৈঠকে বসেছিলেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্তবাবু। শিশু-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য যাতে হাসপাতাল থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্যভবনে পৌঁছায়, বৈঠকে সে নির্দেশ দেওয়া হয়। এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “ঘাটতিটা কোথায়, এবং কী ভাবে তা পূরণ করা যাবে, সে নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মোদ্দা কথা হল, কেউ যাতে দায় এড়াতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা।” |