দলমার দাঁতালদের নিয়ে নাজেহাল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। শস্যহানি,
প্রাণহানি বেড়েই চলেছে।
হাতিকে ঠেকানো যদি বা সম্ভব না-ও হয়, ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো
বা কমানো কি যায় না? কী পরিকল্পনা নিচ্ছে বন দফতর? খোঁজ নিল আনন্দবাজার। |
আশির দশকে ৫-৭টি করে হাতি আসত। আর চলতি বছরে হাতি এসেছে ১৩৫টি! শুধু তাই নয়, দলমা থেকে আসা দাঁতালের দল থেকে মাঝে মধ্যেই দু’একটি করে হাতি থেকে যাচ্ছে এ রাজ্যের জঙ্গলে। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে কয়েক বছর ধরে থেকে যাওয়া এ রকম ‘রেসিডেন্ট’ হাতির সংখ্যা এখন ৩৭। এর উপর ফি-বছর দলমা থেকে হাতির দলের আসাও চলছে। সেই দলও কাটিয়ে যাচ্ছে মাসের পর মাস।
বন দফতরের অনুমান, দলমা থেকে হাতি আসার সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়বেই। কারণ, দলমা-রেঞ্জে খাদ্য-সঙ্কট। তা ছাড়া সেখানে এখন এত বেশি পরিমাণে খনিজ উত্তোলন চলছে, পাথর ফাটাতে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে---হাতির দল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। খাদ্য-সঙ্কট এবং নিরাপত্তাহীনতা মিলেই হাতির দল ঢুকে পড়ছে এ রাজ্যে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা শস্যশ্যামলা। রয়েছে পর্যাপ্ত জল। খাবারের অভাব নেই। এই টানেই প্রতি বছর হাতির অবির্ভাব।
হাতি থেকে তাই নিস্তার নেই। এই সত্যিটা বুঝেই বন দফতরের আধিকারিকেরা এখন হাতি ও মানুষের সহবস্থানের উপরেই জোর দিচ্ছেন। বনসুরক্ষা কমিটির মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, হাতি থাকবে, মানুষও থাকবে। এটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। তার জন্য কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হবে। তার জন্য বিবাদের পথে গেলে চলবে না। মানুষ এটা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু প্রতি বছরই কষ্টের ফসল যদি হাতি খেয়ে যায়, তা হলে কী ভাবেই তা মেনে নেওয়া সম্ভব? কী ভাবেই বা ক্ষোভ সামলাবেন গরিব চাষিরা? যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তা তো নিতান্তই কম। তাতে কী ভাবে চলবে?
বন দফতরের কর্তারাও বিষয়টি মানছেন। তাই হাতিকে জঙ্গলের মধ্যে আটকে রাখার নতুন একটা পরিকল্পনা নিয়েছে বন দফতর। আটকে রাখতে হলে খাবারের জোগান প্রয়োজন। তার জন্য গত তিন বছরে ৩৫৭ হেক্টর জমিতে হাতি খেতে পারে এমন গাছ লাগানো হয়েছে। তার মধ্যে যেমন রয়েছে ঢাড্ডা ঘাস, চালতা, কাঁঠাল, কুম্ভি, লাটো, কলাগাছ, তেমনই রয়েছে প্রচুর পরিমাণ বাঁশ। আর জলের খোঁজেও হাতিকে যাতে ঘুরে বেড়াতে না হয়, সে জন্য জলাধারও তৈরি করা হয়েছে। মেদিনীপুর বনবিভাগের ডিএফও আশিস সামন্ত, খড়্গপুরের ডিএফও মিলনকান্তি মণ্ডল, রূপনারায়ণের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা, ঝাড়গ্রামের ডিএফও অশোকপ্রতাপ সিংহ জানিয়েছেন, জঙ্গলের ভিতরে হাতির খাবারের উপযোগী আরও গাছ লাগানো হবে। আরও অনেক বেশি জলাধার তৈরি করা হবে। যাতে হাতিকে খাবারের জন্য জঙ্গল থেকে না বেরোতে হয়। কিন্তু শুধু খাবার-উপযোগী গাছ লাগিয়ে কি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? যেখানে হাতির দল খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত বদলেছে, ধান, আলু, কপি থেকে টমেটো পর্যন্ত খেয়ে নিচ্ছে? ঐরাবতকে আটকে রাখা কি সম্ভব? বন দফতর অবশ্য জানিয়েছে, শুধু খাবার দিয়ে সম্পূর্ণ আটকে রাখা সম্ভব নয়। তার জন্যও অবশ্য পরিকল্পনা নিয়েছে বন দফতর। দু’ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই মতো ধীরে ধীরে কিছু কাজও হচ্ছে। পরিখা কেটে বা বিদ্যুতের তার দিয়ে গতি রোধ করা, আর জঙ্গল এলাকার পাশাপাশি জমিতে লঙ্কা চাষ করা। রূপনারায়ণ ডিভিসনের হুমগড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ঘেরা হয়েছে। ফলে ১০-১২টি গ্রামের প্রায় ১৩০০ হেক্টর জমিতে শস্যহানি আটকানো গিয়েছে। আমলাগোড়া, মহালিসাই ও হুমগড়ের কিছু এলাকায় পরিখাও কাটা হয়েছে। যে পরিখা পেরিয়ে হাতি জঙ্গল থেকে বেরোতে পারবে না।
মেদিনীপুর বনবিভাগ আবার তিনটি-স্তরে কাঁটাগাছ লাগাচ্ছে। যে তিনটি-স্তর ভেদ করে হাতি জঙ্গল থেকে বেরোনোর ঝুঁকি নেবে না বলে বিশ্বাস বনকর্তাদের। লালগড়ের বীরকাঁড় এলাকায় এ রকম ৭ কিমি জুড়ে কাঁটাগাছ লাগানো হয়েছে। খড়্গপুর বনবিভাগ কলমাপুখুরিয়া থেকে খড়িকামাথানি পর্যন্ত ১৮ কিমি ও রায়বেড়াতে এক কিমি পরিখা কেটেছে। সেই সঙ্গে জঙ্গল-এলাকার মানুষকে নিখরচায় লঙ্কার চারা ও মাদ্রাজি ওল দিচ্ছে বন দফতর। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারও দিচ্ছে। বন দফতর জানিয়েছে, চাষিকে খরচ করতে হচ্ছে না। উল্টে লাভ তাঁর। তা দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে এই চাষ করছেন। কারণ, ধান, আলু লাগালে তা হাতিই খাবে। কোনও লাভ নেই। কিন্তু লঙ্কা বা ওল খাবে না। এটা দেখে জঙ্গল এলাকার অনেক মানুষই এই বিকল্প-চাষে গুরুত্ব দেবেন বলে বন দফতর মনে করছে। বনাধিকারিকদের কথায়, “সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। তবে হাতি ও মানুষের সহবস্থানের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এক জন আর এক জনের শত্রু হলে চলবে না।”
|