ভূমধ্যসাগরের তীরে এই অট্টালিকায় মিশে রয়েছে স্মৃতি এবং উৎসব।
পোশাকি নাম ‘ফেস্টিভ্যাল প্যালেস।’ আজ এত বছর পর যার প্রাঙ্গণ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সাবেকি ঘরানার বদলে এখন তা অনেক বেশি ঝাঁ চকচকে। যথেষ্ট আধুনিক। কিন্তু এই বাড়িতেই তো ১৯৫৮ সালে ‘পথের পাঁচালি’ সেরা ছবির মুকুট পরেছিল। ১৯৮৩ সালে পুরস্কৃত হয়েছিল মৃণাল সেনের ‘খারিজ’-ও।
আজ সেই প্রাসাদেই এক নতুন ছায়াছবির প্রদর্শন! যার নাম জি-২০। যার চিত্রনাট্যে প্রতিফলিত ‘গ্রিক ট্র্যাজেডি’! আর সেই ‘চলচ্চিত্রের’ প্রধান কুশীলব, অর্থাৎ জি-২০ ভুক্ত দেশগুলি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব এই মুহূর্তে শশব্যস্ত এই ‘উৎসব প্রাসাদে’।
কী বিচিত্র ইতিহাসের সমাপতন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন এখানে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয় সেই ১৯৪৬ সালে, স্থানীয় ক্যাসিনো মিউনিসপ্যাল-এ ভারতীয় পরিচালক চেতন আনন্দের ছবি তখন প্রদর্শিত হওয়ার সুযোগ পায়। ছবিটি ছিল ম্যাক্সিম গোর্কির কাহিনি অবলম্বনে ‘নীচা নগর’। সেই ছবির কেন্দ্রীয় চিন্তাভাবনায় ছিল মানুষের যন্ত্রণা, দারিদ্র এবং বিক্ষোভ। আর আজ এত বছর পরে এই উৎসব প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে যে ছবিটা দেখছি, তা-ও কিন্তু বিক্ষোভেরই। আরও স্পষ্ট করে বললে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের। অনেকটা কি সেই ‘নীচা নগরের’ চরিত্রগুলিরই প্রতিফলন নয়?
অথচ রাষ্ট্রনায়কেরা হাসিমুখে ছবি তুলছেন। এক জন অন্য জনকে জড়িয়ে ধরছেন। হাতে হাত মেলাচ্ছেন। সুপরিকল্পিত, অত্যাধুনিক মিডিয়া সেন্টার-এ নানা ধরনের মনোহর দোকান। পাশাপাশি চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্মিত স্থায়ী দোকান থেকে নানা দেশের সাংবাদিকরা কিনছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের লোগো দেওয়া টি-শার্ট অথবা কফি মগ। যেন একটা মেলা বসেছে। তারই মধ্যে আজ দু’দিনের বৈঠক সেরে যখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের দেশে ফেলার পালা, তখন কিন্তু ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন ভারতীয় সাংবাদিকদের মুখে মুখে ফিরছে। এ বারের সম্মেলন কি আসলে জি-২০? নাকি জি-৩? ওবামা, সারকোজি আর আঙ্গেলা মেরকেল? আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানির তিন রাষ্ট্রপ্রধান যে গোটা দিনে কত বার কথা বলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
গ্রিসের মতো একটি দেশ, যে আদৌ জি-২০-এর সদস্যই নয়, সে গোটা ইউরো জোনকে যে চরম নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছে, তা স্পষ্ট। গোটা জি-২০ সম্মেলন যেন সেই গ্রিক ট্র্যাজেডি নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। সঙ্কটমোচনের পথ কী? চিন? কিন্তু সেখানেও রয়েছে ‘নানা মত’। চিনের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়া উচিত হবে কি না, তা নিয়ে একটি বড় অংশের প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিমী দুনিয়ার এই অংশটির বক্তব্য, চিনের সাহায্য নিলেই কিছু বাধ্যবাধকতা এসে যাবে। সে দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ আর তোলা যাবে না। দরকষাকষি বাড়িয়ে চিন পশ্চিমী দুনিয়ার মুখে কুলুপ আঁটতে চাইবে। তবে এই মতের পাশাপাশি অন্য একটি পক্ষ অবশ্য মনে করছে, ‘ইউয়ান’ ছাড়া গতি নেই।
কচি কলাপাতা রঙের মখমলের মতো নরম কার্পেট আর তার চার দিকে নানা দেশের মিডিয়া সেন্টার। জাপানের এক মহিলা সাংবাদিক ইবোকো ইনুর সঙ্গে সেখানেই আলাপ। ‘জাপান টাইমস’-এ কর্মরত এই সাংবাদিককে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “শুধু দুটো বিষয়ে আমার আগ্রহ। প্রথমত, গ্রিসের সঙ্কটে ইউরো জোন ভেঙে যাচ্ছে কি না। দ্বিতীয়ত, এই পরিস্থিতিতে চিন কী করবে।” হাতি আর ড্রাগনের বিরোধ নিয়েও (ভারত-চিন) মস্করা করতে ছাড়লেন না ইবোকো! তার পর জাপানি সাংবাদিক বললেন, “এখন আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে।”
জাপান না হয় ভারতের পাশে রয়েছে। কিন্তু ভারত ঠিক কোথায় রয়েছে এই মহাসম্মেলনে? অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে ঢুকতেই একটা বিরাট টাচ স্ক্রিনে দেখছি বিশ্ব মানচিত্র। সেই মানচিত্রে বিশেষ রঙে চিহ্নিত রয়েছে জি-২০-র দেশগুলি। কোনও একটিকে স্পর্শ করলেই তার ইতিহাস, ভূগোল, সভ্যতা এবং পরিসংখ্যান একে একে ফুটে উঠবে পর্দায়। ভারতকে স্পর্শ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস থেকে এখনকার জিডিপি বা মোট জাতীয় উৎপাদন, জনসংখ্যা সব বেরিয়ে এল। মানচিত্রে না হয় উজ্জ্বল! কিন্তু এ বারের জি-২০-তে ভারত সত্যিই কতটা প্রাসঙ্গিক? ইউরোপের দেশগুলির অসুখ নিয়েই তো সবাই মত্ত। গত কাল তো এমনই ব্যস্ততা ছিল যে, মনমোহনের সঙ্গে আলোচনায় বসতেই পারলেন না সারকোজি। ইউরোপ নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন গোটা দিন। শুধু ভারতই নয়, কাল চিনের সঙ্গে নির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করে উঠতে পারেনি ফ্রান্স। আসল কথা হচ্ছে, ভারত-চিন-জাপানকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যতই প্রয়োজন থাকুক, এখন তারা নিজেদের সঙ্কটমোচনে অনেক বেশি ব্যস্ত।
ভারতীয় কর্তারা কিন্তু মনে করছেন, এ বারের জি-২০-তেও ভারত যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক। আজ সাংবাদিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানান, ভারত যে তিনটি বিষয়ে জোর দিচ্ছে, সেগুলি মেনে নিয়েছে জি-২০। কী সেগুলি? এক, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা। দুই, কর ফাঁকি বন্ধে তথ্যের আদানপ্রদান। এবং তিন, কালো টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা। এই তিনটিই জি-২০টির বিবৃতিতে স্থান পেয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বা যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াও জানান, সম্মেলনে মনমোহন ক’টা বৈঠক করলেন বা কত বার স্বর চড়ালেন, তা দিয়ে গুরুত্ব মাপা যাবে না। ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, আর্থিক শৃঙ্খলা যে যথেষ্ট মজবুত, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা ও এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির ভিতরে থাকাটাও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
দিল্লি রওনা হওয়ার আগে পর্যন্ত মনমোহন বারবার খোঁজ নিয়েছেন, গ্রিক সংসদে কী হচ্ছে। মাঝে সাংবাদিকদের বলেছেন, এই এক বা দু’দিনের আলোচনায় সমস্যা মেটার নয়। সবাইকে নিয়ে চলে সমাধানের পথ বের করতে হবে। প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি তা হলে ‘গ্লোবাল গুরু’ হয়ে উঠছেন (ওবামাও নাকি তাঁর সম্পর্কে এক বার এমনই বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন)? প্রধানমন্ত্রীর জবাব, আমি গ্লোবাল গুরু নই। তবে গ্রিসের ভাগ্য নিয়ে তাঁর তথা ভারতের উদ্বেগ যে রয়েছে, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। |