একের পর এক মণ্ডপে থিমের বৈচিত্র্য আর দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা দেখতে দেখতে দর্শকদের মনে হতেই পারে বোধহয় তাঁরা চন্দননগরে এসে পড়েছেন। ছোট বাজেটের পুজো থেকে বড় বাজেটের পুজো সব উদ্যোক্তাদের মধ্যে যেন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ঐতিহ্যকে ছোঁয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। তবু তারই মধ্যে অনেকে পরম্পরা আর আধুনিকতা নিয়ে নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলতে সচেষ্ট। আর এ সব নিয়েই এ বার জমজমাট উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর-কল্যাণগড়ের জগদ্ধাত্রী পুজো।
পুজোর আয়োজনের পথ ধরে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে নানা রকম থিমের উপহার। কোনও পুজো কমিটি ‘জঙ্গলমহলে’ দেবীর আরাধনার আয়োজন করেছেন। আবার কোথাও মণ্ডপ পরিকল্পনায় ঠাঁই পেয়েছে বিখ্যায় হিন্দি ছবি ‘শোলে’র গব্বর সিং। কোখাও আবার মণ্ডপ কাঁপাচ্ছেন ডাকাতরানি ফুলনদেবী। জৈন মন্দির, ইসকনের মন্দিরকেও থিম হিসাবে বেছে নিয়েছেন পুজোকমিটিগুলি। মণ্ডপ তৈরির জন্য বেচে নেওয়া হয়েছে শ্লেট-পেনসিল থেকে বাঁশ, চাটাই, প্লাইউড প্রভৃতি।
শুধু মণ্ডপ নয়, থিমের ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি প্রতিমাও। একটি পুজো কমিটির আকর্ষণ পেনসিলের প্রতিমা। পুলিশের হিসাবে এ বার অশোকনগর-কল্যাণগড়ে বড় পুজোর সংখ্যা ১৮টি। তার মধ্যে বিগ বাজেটের পুজো ৫টি। |
তবে চন্দননগরের চারদিনের পুজোর রীতি নয়, এখানে নবমীতে একদিনেই সম্পন্ন হয় পুজো। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুজো দেখার ভিড় উপচে পড়ে। রাত জেগে চলে মণ্ডপ আর প্রতিম দর্শন। পুজো উপলক্ষে প্রতিবারই বিশেষ নজরদারি থাকে জেলা পুলিশের। এ বার তা অব্যাহত। কল্যাণগড়ে আলাদা একটি পুলিশ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি মণ্ডপের সামনে যাতে পুলিশ মোতয়েন করা যায় তারও চেষ্টা চলছে।
দ্বাদশ পল্লি পুজো কমিটির এ বারই প্রথম বছর। আর তাই চমক দেওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সারা। থিম হিসাবে উদ্যোক্তারা বেছে নিয়েছেন জঙ্গলমহল। তৈরি হয়েছে ‘জঙ্গলমহল হল্ট’ প্ল্যাটফর্ম। দেখা যাবে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। প্রায় পাঁচ কাঠা জমিতে তৈরি করা হয়েছে জঙ্গল। আগে থেকেই এই এলাকায় শাল ও সেগুনের বাগান ছিল। সেটিকে ব্যবহার করে আরও গাছের ব্যবস্থা করে জঙ্গল তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে পুকুর। তবে বন্দুক হাতে মাওবাদীদের দেখা না পাওয়া গেলেও দর্শকরা যাতে মাওবাদী ডেরা দেখতে পান তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে রিলিফ ক্যাম্প, প্রাথমিক বিদ্যালয়, বহু চর্চিত লালগড় থানা, সিআরপিএফ। জীবন্ত মডেলের মাধ্যমে সব তুলে ধরা হচ্ছে। বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে সিআরপিএফ জওয়ান। ছাত্ররা স্কুলে ঢুকছে। মণ্ডপে আদিবাসী নৃত্য পরিবেশনের জন্য পুরুলিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়েছে আদিবাসী নৃত্যশিল্পীদের।
হরিপুর অধিবাসীবৃন্দের পুজো ষোলো বছরের। চট, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়েছে পাহাড়। পাহাড়ের গুহার মধ্যে মন্দির। পাহাড়ে দেখা যাবে দলের সঙ্গীদের নয়ে বসে আছে ফুলনদেবী। এখানেও সব জীবন্ত মডেল। ৮০ ফুট লম্বা, ৬০ ফুট চওড়া মণ্ডপে আলো, শব্দ ও মডেলের মাধ্যমে ফুলনদেবীকে নিয়ে ১০ মিনিটের একটি শো-এরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাহাড়ের আবহের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা। আমরা সবাই ক্লাবের পুজো এ বার ৩২ বছরে পা দিল। বাঁশের চাটাইয়ের ৫০ ফুট উঁচু মণ্ডপ। সামনে দেখা যাবে রাজবাড়ির দারোয়ান ঘোরাঘুরি করছে। ভিতরে প্রতিমার সামনে থাকছেন জীবন্ত স্বামীজি এবং রামকৃষ্ণ। কল্যাণগড় ফুটবল কোচিং সেন্টারের পুজোর থিম শোলের গব্বর সিং। থাকবে দু’টি ঘোড়া ও গব্বরের সঙ্গীরা।রকেট মোড়ের নবোদয় সঙ্ঘের পুজোয় এ বার থিম রবীন্দ্র জন্ম সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে সহজ পাঠ। সহজ পাঠের বিভিন্ন বিষয় বস্তুকে শ্লেট-পেনসিলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আট ফুট উঁচু প্রতিমাও পেনসিলের তৈরি। কয়াডাঙা নব জাগ্রত সঙ্ঘের পুজোর মণ্ডপ তৈরি হয়েছে মহীশূরের একটি জৈন মন্দিরের আদলে। ডাকের সাজের প্রতিমা। কয়াডাঙা নাট্য কলোনির পুজোর মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে মাদুর কাঠি। সাবেক প্রতিমা। পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কাল্পনিক শিব মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে কয়াডাঙা নেতাজি সঙ্ঘের পুজোয়। কুমোরটুলির প্রতিমা।
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ সেবা সমিতির ২০০ বছরের পুজোর মণ্ডপের থিম ইসকনের মন্দির। আলোকসজ্জায় রবীন্দ্রনাথ। আয়োজন করা হয়েছে মেলার। নেতাজি বাগের পুজোয় নেপালের কেটি রাজবাড়ির আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। আলোয় থাকছে পুরীর জগন্নাথ মন্দির। বেকারি মোড় ভ্রাতৃসঙ্ঘের থিম বন্য প্রাণি সংরক্ষণ। মণ্ডপের ভিতরে দেখা মিলবে বিভিন্ন পশু, পাখির। অরুণোদয়ের মণ্ডপ মন্দিরের আদলে। বেতের কাজ নজর কাড়বে। স্কাইলার্ক পুজো কমিটির কাচের মণ্ডপ। পুজো পরিচালনা করেন মহিলারা। আলোয় তুলে ধরা হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী। রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মানিকতলার দিগ্বিজয় সঙ্ঘের পুজোর এ বার প্রথম বছর। মা-মাটি-মানুষের থিমের মণ্ডপে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর আদল। চন্দননগরের আলো চোখ টানবে। |