|
|
|
|
বিতর্ক... |
শারদসাহিত্যে সে স্বাদ আর নেই |
পক্ষে |
মাটির নির্যাস-ভরা আবেগ কই? |
• ‘শারদসাহিত্যে সে স্বাদ আর নেই’ এই অপ্রিয় কথাটা আমি কেন, যাঁরা এখন শারদসাহিত্যের জন্য কলম ধরেছেন, তাঁরা বুকে হাত দিয়ে বললে সেই সত্য কথাটাই বলবেন বলে আমার বিশ্বাস।
শারদসাহিত্য তার গৌরব হারিয়েছে যে শুধু তা-ই নয়, তার মানও নিম্নমুখী। গল্প বলুন বা উপন্যাস, কিছুক্ষণ পড়ার পর চিন্তার খেই হারিয়ে যায় এবং অচিরেই শরীর ও মন বিশ্রাম নিতে চায়। গল্পের কোনও বালাই নেই, শুধু ভাষার চাতুরি। আমরা যে-সব নাম করা লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি এবং মনের দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছি, তাদের কাছে আজকের শারদসাহিত্য মনে কোনও আলোড়ন তুলতে পারে না। অতীতে সেই সব নামজাদা লেখকদের লেখা নিয়ে অনেক ভাল ভাল সিনেমাও তৈরি হয়েছে। বর্তমান লেখকদের লেখা নিয়ে ক’টা সিনেমা হচ্ছে? স্টলগুলোতে দেখি পুজোবার্ষিকীগুলো অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। এই ছবিটা দশ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না। তখন পুজোবার্ষিকীগুলো কবে প্রকাশিত হবে তার জন্য পাঠকরা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতেন। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের লেখাগুলো অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। বড়দের জন্য লেখা তখন লুকিয়ে পড়ার দরকার হত না, অথচ বড়রা সে-সব লেখা পড়ে তাদের মনের খোরাক ঠিকই পেতেন।
কতিপয় সাহিত্যিকদের একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, বিষয়বস্তু যত জটিল হবে, পাঠকদের মনের ওপর ততটাই প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সহজ সরল ভাষায় নিটোল গল্প বলার মধ্যে যে মুনশিয়ানার প্রয়োজন হয়, তা বর্তমান প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে আছে বলে আমি মনে করি না। তাই আজও দু’দশক আগের সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে মনের খিদে মেটাতে হয়।
অরুণ গুপ্ত। নিউ রায়পুর রোড, কলকাতা ৮৪
|
• শারদসাহিত্য এখন আর শরৎ-সাহিত্য নেই, বাণিজ্যিক নানা কারণে তা এখন গ্রীষ্ম-বর্ষার সাহিত্য। আগে, মহালয়ার ঠিক আগে-আগে শারদসংখ্যাগুলো বাজারে পেতাম। এখন পুজোর এত আগে এগুলো বেরোয় যে, গরমে ফুলকপি খাবার মতো মনের অবস্থা হয়। যে কোনও উপায়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শপিং মলের কায়দায় ‘একটা কিনলে একটা ফ্রি’-এর মতো গানের সিডি, শ্যাম্পুর প্যাকেট কিছুই বাদ যাচ্ছে না। শারদীয়া সংখ্যার সম্মানদক্ষিণা বেশি বলে লেখকরাও দশভুজার মতো দশ হাতে দশটি পত্রিকায় লেখবার জন্য মনে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো লেখা হয় লিখতে পারছেন না, বা চাইছেন না। চকচক করলেই যে সোনা হয় না, শারদসাহিত্যের এখনকার চেহারাতেই তা স্পষ্ট।
অরূপরতন আইচ। রাজীব গাঁধী রোড, কোন্নগর, হুগলি |
|
• বর্তমানে শারদীয়া সংখ্যার লেখক-কবিরা উচ্চপদস্থ চাকুরে। মাটির নির্যাস-ভরা যন্ত্রণা, ইচ্ছা, আবেগ সাহিত্যে অনুপস্থিত। তাঁরা এ সব বোঝেন কি না সন্দেহ। নব্য কবি-সাহিত্যিকদের লেখা তো শারদ সংখ্যায় দেখাই যায় না। তাই বর্তমান তরুণ সমাজের মনে শারদসাহিত্যের স্বাদ আকর্ষণ নেই। লেখক-পাঠকদের মেলবন্ধনও নেই। লেখকরা যেন বলেন আমাকে দেখুন। সম্পাদকমণ্ডলী বিজ্ঞাপনের চমক নিয়ে এত ব্যস্ত যে, সাহিত্যের গুণাগুণ নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই। খরচ বিক্রির আগে উঠে এলে শারদ সাহিত্যের উৎকর্ষ নিয়ে চিন্তা থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, বর্তমান প্রকাশিত শারদ সংখ্যাগুলো যেন বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছে। মানুষ বিমুখ।
রীতা পাল। উমেশ নিয়োগী রোড, কলকাতা-২৪ |
|
|
|
বিপক্ষে |
প্রাণের রেস্তোরাঁয় মহাভোজ |
• সময়ের হাত ধরে শারদসাহিত্য এখন অনেক বেশি পরিণত। মনে পুজোর আনন্দের জাল বোনা আজও শুরু হয় শারদসাহিত্য পাঠের মাধ্যমে। এই সময়কার লেখনীগুলোর মধ্যে যেমন উৎসবমুখরতা থাকে, তেমনি থাকে কেমন একটা ভালোবাসার মানুষটির জন্য মন-হু-হু-করা টান। মণ্ডপের আলোকসজ্জা দর্শনের আগেই মনের ফ্লাডলাইটে বন্যা বওয়াতে শুরু করে এই শারদসাহিত্য। প্রাণের রেস্টুরেন্টে তখন মহাভোজ। বর্তমানের শারদসাহিত্য আকাশকুসুম রচনা করে না। বরং তা সব স্তরের সাহিত্যপ্রেমীকে দেয় বাস্তবের ছোঁয়া। সম্পর্কের টানাপোড়েনে একান্ত আপন মানুষটিকে মনের মণিকোঠায় অমূল্য রতন করে তোলে এখনকার শারদসাহিত্য। তাই শারদসাহিত্য হয়ে ওঠে সেই জিয়নকাঠি, যার স্পর্শে আমরা ‘প্রেম’কে নব-নব রূপে আবিষ্কার করি। সে জন্য আমার কাছে শারদসাহিত্য মানেই মনের মধ্যে ‘ওর’ জন্য ঢ্যাং-কুড়-কুড়।
আনন্দগোপাল সালুই। লালবাজার, বাঁকুড়া
|
|
• শারদোৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় এ কথা মানছি। কিন্তু তার চাইতে বহু গুণ বেশি অর্থ ঢালা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ‘নির্বাচনী উৎসবগুলি’-তে। উৎসবের দিনগুলিতে আমরা একঘেয়ে জীবনের বাঁধন কেটে বেরিয়ে পড়ি অন্য এক আলোর জগতে। যেখানে শিল্প কারুকার্য আছে, ব্যবসা-বিকিকিনি আছে। আছে অল্প দিনের জন্য হলেও বহু মানুষের রুটিরুজির সুযোগ। আছে বিনোদন। কিন্তু নির্বাচনী উৎসবগুলিতে আমরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কী পাচ্ছি? হ্যাঁ, পাচ্ছি অপদার্থ নেতা-মন্ত্রী, সন্ত্রাস। কালো টাকার ধনকুবের। আবার তাদের উত্তম শিক্ষাদানের জন্য বিশিষ্ট সমাজসেবীদের নীতিশাস্ত্রের পাঠশালা খুলে বসতে হচ্ছে দিল্লির রামলীলা ময়দানে। সেখানও রীতিমত উৎসবের মেজাজ, অর্থের ছড়াছড়ি।
তা হলে মা দুগ্গার সন্তানদের আর দোষ কোথায়? প্রতিমা শিল্প, মণ্ডপ শিল্প, অভিনব আলোকসজ্জায় পারদর্শী শিল্পরসিক বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার মতো বিরাট মঞ্চ এই উৎসব। এর জন্য বোধহয় দিকে দিকে শুরু হয়ে গেছে থিম পুজোর লড়াই। এটাও আমার কাছে একটা ভাল দিক। কেননা, আমরা টাকা ঢালছি উৎকর্ষতার লড়াইয়ে, আনন্দের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রভূমিতে।
উত্তমকুমার বিশ্বাস। বারাসত, উত্তর চব্বিশ পরগনা
|
• শারদোৎসবের সঙ্গে শারদসাহিত্য হাত ধরাধরি করে চলছে দীর্ঘদিন। বছরভর প্রতীক্ষা থাকে শারদসাহিত্যের জন্য। কী উপন্যাস থাকছে, কী কবিতা ছাপা হচ্ছে বা কে গল্প লিখছেন, তা জানিয়ে উৎসব শুরু হবার অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায় প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর। শারদসাহিত্যের সেই স্বাদ যদি না থাকত, তা হলে কি পত্রিকাগুলো এ ভাবে বাজার ধরার জন্য ঝাঁপাত? এখন তো মহালয়ায় নয়, তার অনেক আগে থেকেই পত্রিকা আমাদের হাতে পৌঁছচ্ছে। পাশাপাশি দু’দশক আগের কথাও যদি ভাবি, তখনকার তুলনায় এখন তো পত্রিকার সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। দৈনিক কাগজগুলোর পাশাপাশি পাক্ষিক বা মাসিক পত্রিকাগুলোও সমান তালে পুজোসংখ্যা প্রকাশ করছে। ছাপা, বাঁধাই, ছবিতে, কাগজে গুণগত মান অনেক উন্নত হয়েছে। লেখার ব্যাপ্তি ও পরিসরও আজ অনেক বিস্তৃত। পাশাপাশি, সারা রাজ্য জুড়ে শ’য়ে শ’য়ে লিটল ম্যাগাজিনও শারদসাহিত্যের মস্ত বড় আধার। রাত জেগে প্রুফ দেখা, কভার ডিজাইন করা, লেখা জোগাড় করবার জন্য দৌড়াদৌড়ি সবই আছে। কিছু লিটল ম্যাগাজিন তো সমস্ত বিষয়েই বড় পত্রিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত! শারদসাহিত্যের সেই স্বাদ যদি না থাকবে, সেই চাহিদা যদি না থাকবে, পাঠক যদি না চাইবে, তা হলে এত শারদ পত্রিকা প্রকাশিত হত না। ফলে, ‘শারদসাহিত্যে সে স্বাদ আর নেই’ এ কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।
শুভঙ্কর সাহা। সিন্দ্রানী, উত্তর ২৪ পরগনা
|
• শারদসাহিত্যের আগের দিনের সে স্বাদ সত্যিই তো আর নেই, অনেক অন্য ভাবে ভাল হয়েছে, বিচিত্রগামী বিষয়গুণে, আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরে। বিনোদনের মাধ্যম এখন নানারকম, কিছু পাঠক-পাঠিকা না-হয় সাময়িক ভাবে সে দিকে গেলেনই গোলাপাঠকের গেলার জন্য গোল গল্প বরং তাঁরা টিভি সিরিয়ালে দেখে নিচ্ছেন। মনে মনে দেখার জন্য, যা কিনা স্বাদু পদে পদে, সাম্প্রতিক গল্প-উপন্যাস-কবিতার যে খণ্ডচিত্র শারদসাহিত্যের সূত্রে পাই, তা বরং অনেক বেশি গভীরতার সঞ্চার করে, বিমূর্ততার দিকে তার যাত্রা। এ বারের শারদীয় দেশে সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসটাই ধরুন না! চিত্রশিল্পীর অবচেতন, গল্পের গতিতে মিশেছে অনন্য মুনশিয়ানায়। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় অদৃষ্টপূর্ব অনুভববেদ্যতায় সন্তানদের চোখ দিয়ে এঁকেছেন ছন্নছাড়া নকশাল প্রজন্মকে। সুনীল-শীর্ষেন্দুর কলমে অভিনবত্বের ঝলক এখনও কখনও-সখনও দেখা যায়। ‘বয় মিটস গার্ল’ গোছের গল্প ছেড়ে শারদসাহিত্য এখনও আরও পরিণত বিষয় পাচ্ছে সঙ্গীতা-স্মরণজিৎ-শেখর-প্রচেত-তিলোত্তমা-কৃষ্ণেন্দু-কাবেরী-হিমাদ্রিকিশোর-অমিতাভ সমাজপতিদের হাতে। আগেকার দিনের মতো লেখকরা এখন আর প্রধানত সাংবাদিক-সাহিত্যিক নন, পত্রিকাও এখন বেরোয় কত রকম! খেলা নিয়ে জীবনমুখী লেখার যে ধারা মতি নন্দীর তৈরি, সে পথে এগিয়েছেন অনেকেই। শারদসাহিত্যকে এই সময়ের এক টুকরো আয়না হিসেবে যদি ধরি, তবে দেখেশুনে, চেটেপুটে, লেখা-পড়া তথা রসাস্বাদনের দিনকাল তো উজ্জ্বল রূপেই প্রতিভাত হয়!
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। রহড়া, কলকাতা ১১৮ |
|
|
ডিসেম্বর মাসের বিতর্ক |
উন্নয়ন মাওবাদের উত্তর নয় |
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ নভেম্বরের মধ্যে এই ঠিকানায়
ডিসেম্বর মাসের বিতর্ক, সম্পাদকীয় বিভাগ,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১ |
|
|
|
|
|
|
|
|