পুলিশ বলছে, ‘খোঁজ নেই’।
অথচ মঙ্গলবার গোপন আস্তানা থেকে তৃণমূল আশ্রিত সেই আজাদ মুন্সীই দাবি করল, “সিপিএমের ডাবলু আনসারি ও তৃণমূলের একাংশের যোগসাজশে মিথ্যা অভিযোগে আমায় ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে।”
বীরভূমের নানুর ও বর্ধমানের মঙ্গলকোটে খুন-লুঠপাটের নানা ঘটনায় পুলিশের খাতায় নাম থাকা আজাদের বিরুদ্ধে এখন মূল অভিযোগ, এক তৃণমূল নেতার মদতে ইটভাটায় অবাধ তোলাবাজি। সোমবার মঙ্গলকোটের আড়াল গ্রামে হানা দিয়ে পুলিশ তার তিন সঙ্গীকে অস্ত্র-সহ ধরে। মঙ্গলবার কাটোয়া আদালতে তোলা হলে তাদের তিন দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজাদ এখনও ‘অধরা’।
পুলিশের বক্তব্য, ধৃতদের জেরা করে আজাদ ও তার বাহিনীর বাকিদের ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আজাদের দাবি, তার কোনও বাহিনীই নেই। তোলাবাজিও সে করে না। আড়াল গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের বড় ছেলে আজাদের পাল্টা দাবি, “আমার পক্ষে তোলাবাজি সম্ভব নয়। কয়েক বিঘা জমিতে চাষ করে খাই। আমার নাম করে কিছু লোক তোলাবাজি করছে জেনে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। সে কারণে সব তোলাবাজ এক হয়ে আমার পিছনে লেগেছে।”
আজাদ ও তাঁর ভাই অঞ্জন মুন্সীর খেদ, “খবরের কাগজে আমাদের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ পড়ে বাবা মুষড়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।” কিন্তু পুলিশের খাতায় ‘ফেরার’ ডাবলু আনসারিও এ দিন গোপন ডেরা থেকে অভিযোগ করেন, “ওই দুই ভাই মিলে ইটভাটা, বালিঘাট ও বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা তুলেছে। ওদের জন্য আমার ইটভাটাও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।” অঞ্জনের পাল্টা প্রশ্ন, “তোলাবাজি করলে আমরা কি কুঁড়েঘরে থাকতাম, না ডাবলু আনসারির মতো বিলাসবহুল বাড়ি বানাতাম?”
এক সময়ে মঙ্গলকোটের ‘ত্রাস’ বলে পরিচিত ডাবলু আনসারির হাত ধরেই মঙ্গলকোটে আজাদের ‘উত্থান’ শুরু। সে সময়ে কিছু দিন আজাদকে সামনে রেখেই ডাবলু ‘সন্ত্রাস’ চালাত বলে অভিযোগ। কিন্তু এখন সম্পর্কটা সাপে-নেউলে। আজাদের কথায়, “ডাবলুকে এক সময়ে আমি ‘চাচা’ বলে ডাকতাম। খুব ভাব ছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে আড়াল গ্রামে রাস্তা তৈরির টাকা নয়ছয় করেন মঙ্গলকোট পঞ্চায়েতের তৎকালীন প্রধান ডাবলু। এর পরেই অত্যাচার শুরু হয়। আমার কাকা কংগ্রেস করতেন। ২০০০ সালে ‘গরুচোর’ অপবাদ দিয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা চালায় সিপিএমের বাহিনী। আমরা গ্রামছাড়া হই।”
কয়েক বছর পরে মঙ্গলকোটের প্রাক্তন ওসি তাপস পালের জমানায় গ্রামে ফেরে আজাদ। বেশ কিছু দিন পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে কাজও করে। ডাবলু অবশ্য আজাদের সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগের কথাই স্বীকার করতে চাননি। তাঁর দাবি, “এলাকায় একের পর এক চুরি-ডাকাতিতে জড়িয়ে যাচ্ছিল আজাদ। সে কারণে ওসি তাপস পাল ওকে ‘সোর্স’ হিসেবে রেখে দিয়েছিল।” ওই সময়েই, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে আজাদের কাকার ছেলে সাইফুল খুন হন। আজাদের অভিযোগ, “আমি থানায় থাকার সময়েই এক ওসি-র মদতে সিপিএমের বাহিনী বাস থেকে নামিয়ে আমার খুড়তুতো ভাইকে খুন করে। ভয়ে আমরা বীরভূমে চলে যাই।”
ডাবলু অবশ্য তা মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “পঞ্চায়েত ভোটের পরে নতুনহাট পিরতলায় আজাদ আর তার এক সঙ্গী আমায় মারতে এসেছিল। সঙ্গীটি অস্ত্র-সহ ধরা পড়লেও আজাদ ফস্কে যায়। এর পরেই ও এলাকা ছেড়ে বীরভূমের পাপুড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।” তৃণমূলের বীরভূম জেলা সম্পাদক তথা মঙ্গলকোটে দলীয় পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আজাদকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আজাদ নিজেই বলেন, “বীরভূমে গিয়েই আমি অনুব্রতবাবুর সান্নিধ্যে আসি।” কিন্তু ‘মদত’ দেওয়ার অভিযোগ দু’জনেই অস্বীকার করেছেন। বরং আজাদের মতো অনুব্রতবাবুরও দাবি, “ডাবলু এবং সিপিএমের লোকেরাই ওদের ফাঁসাতে চাইছে।” তবে এই ‘ষড়যন্ত্রে’ দলের কারও যুক্ত থাকার কথা তিনি মানতে চাননি।
কিন্তু আজাদের অভিযোগ, “সিপিএমের কিছু দুষ্কৃতী তৃণমূলে ঢুকেছে। মঙ্গলকোট ব্লকে দলের কোর কমিটির এক সদস্য তাদের পাশে রয়েছেন। দোসর হয়েছে ডাবলু আনসারি। সে কারণেই পুলিশ আমাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করছে।” কিছু দিন আগেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী পরিচয় দিয়ে দলনেত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন স্থানীয় কামালপুর গ্রামের শেখ খোকন। তাতে অভিযোগ করা হয়, আজাদ ও অঞ্জন এক লক্ষ টাকা দাবি করায় তিনি গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আজাদের পাল্টা অভিযোগ, “খোকন আমার নাম করে লক্ষাধিক টাকা তুলেছে। সেটা ফেরত দিতে বলাতেই খেপে গিয়ে মিথ্যা নালিশ করেছে।”
আজাদের কথা সমর্থন করে তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য, মঙ্গলকোটের অপূর্ব চৌধুরীও দাবি করেন, “ শেখ খোকন এক জন তোলাবাজ। তার কথায় গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না।” উল্টো দিকে, কোর কমিটির আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লিয়াকত আলি আবার বলেন, “খোকন খুবই ভাল ছেলে। সে যদি তোলাবাজিই করবে, তা হলে গ্রাম ছাড়বে কেন? ওদের সঙ্গে হাত মেলায়নি বলেই তো ওকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে!”
এর পরেও অনুব্রতবাবু অবশ্য দাবি করেন, “আমাদের দলে কোনও দ্বন্দ্ব নেই।” আর, মঙ্গলকোট থানার ওসি দীপঙ্কর সরকার বলেন, “ডাবলু আর আজাদ দু’জনেই পলাতক। তল্লাশি চলছে।” |