এ যেন গারদের ভিতরে আরও একটি গারদ!
এত দিন এক গারদের ভিতরে কার্যত জেলের কয়েদিদের মতো দিন কাটত রোগীদের। ‘নিরাপত্তা’র কারণ দেখিয়ে এ বার সেই ভিতরের অংশটিও কর্তৃপক্ষ ঘিরে দিলেন গ্রিল দিয়ে। অভিযোগ, এর ফলে চিড়িয়াখানার পশুরা যে অবস্থায় থাকে, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা দাঁড়াল রোগীদের। তাঁরা বিকেলের পরে ঘরের বাইরে বেরোতে পারছেন না। গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে বহু বার সাধ্য-সাধনার পরে হাসপাতালের তরফে কারও সাড়া মিলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ভাবে বদ্ধ জায়গায় দিনের পর দিন আটকে থেকে মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ। বড় কোনও বিপদ ঘটলে ওয়ার্ড থেকে বেরোতে না পেরে বড়সড় বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। স্থান: লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল।
বছর কয়েক আগে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে রোগিণীদের বিনা পোশাকে রেখে দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় বিভিন্ন মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। আর এ বার মানসিক রোগীদের স্বাভাবিক পরিবেশে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও এ ভাবে কেড়ে নেওয়ায় ফের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তরফে দফায় দফায় লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মানসিক রোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ স্বাস্থ্য-অধিকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। |
লুম্বিনীতে গ্রিল ঘেরা এই ঘরেই রাখা হয় মনোরোগীদের। —নিজস্ব চিত্র |
উপ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা সচ্চিদানন্দ সরকার বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থেই গ্রিল দিয়ে জায়গাটি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে এত আপত্তি উঠবে, সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভাবেননি।” কাদের নিরাপত্তা? সচ্চিদানন্দবাবু বলেন, “অবশ্যই রোগীদের। তাঁরা যাতে সকলের নজর এড়িয়ে কোনও ভাবে বাইরে বেরিয়ে না পড়েন, সে জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে আমি নিজে হাসপাতালে গিয়ে সরেজমিন দেখব। যদি মনে হয় সত্যিই খুব ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে পরিবেশ, তা হলে গ্রিল খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
এ ভাবে গ্রিল দিয়ে ওয়ার্ডটি ঘিরে দিতে স্বাস্থ্য দফতরের খরচ হয়েছে দু’লক্ষ ৪১ হাজার ৮২৬ টাকা। যেখানে হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প টাকা না থাকার অজুহাতে আটকে রয়েছে, সেখানে গ্রিলের পিছনে কী ভাবে এত টাকা বরাদ্দ হল? স্বাস্থ্যকর্তারা এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের নিরাপত্তার জন্যই তাঁরা গ্রিল বসিয়েছেন। এক কর্তার কথায়, “রাতের দিকে অনেক রোগীই হিংস্র হয়ে ওঠেন। তখন ওই ওয়ার্ডে ঢুকতে নার্সরা ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সে জন্যই অনেক ভাবনাচিন্তা করে এই ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছিল।” কিন্তু কোনও রোগী হিংস্র হয়ে উঠলে সেই মুহূর্তে তো তাঁর বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন। অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে সেই হিংস্র রোগীকে রেখে দিয়ে চিকিৎসক, নার্সরা গ্রিলের বাইরে থেকে নজর রাখবেন, এমনটা কি কোনও সভ্য দেশে সম্ভব? স্বাস্থ্যকর্তারা এর উত্তরে নীরব থেকেছেন।
সুপার কালীদাস দত্ত বলেন, “এ নিয়ে এত বিতর্কের কী আছে, বুঝতে পারছি না। গ্রিল ঘেরা করিডরের বিষয়ে কর্মীরা দাবি তুলেছিলেন। সেই প্রস্তাব স্বাস্থ্য ভবনে পাঠিয়েছিলাম। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা সব দেখেশুনে কাজ করেছেন। অর্থ দফতরও অনুমোদন দিয়েছে। তার পরে এত হইচই অনর্থক।” |