রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে সদ্যোজাত শিশু-মৃত্যুর ঘটনায় এক জন ‘পূর্ণ সময়ের’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি তুলল সিপিএম এবং বিজেপি। সোমবার আলাদা আলাদা করে ওই দাবি তুলেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র ও বিজেপি-র তারকা সাংসদ স্মৃতি ইরানি। স্মৃতি এদিন বিজেপি-র এক প্রতিনিধিদল নিয়ে বিসি রায় শিশু হাসপাতালে গিয়েছিলেন।
বি সি রায় শিশু হাসপাতালে চার দিনে ১৭ এবং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক দিনে ১২টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম থেকেই সিপিএম-বিজেপি একই সুরে সরকারকে আক্রমণ করছে। সূর্যবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি শিশু-মৃত্যু নিয়ে ‘রাজনীতি’ করতে চান না। তবে তাঁর অভিমত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত স্বাস্থ্য দফতর নিজের হাতে না-রেখে এক জন পূর্ণ সময়ের মন্ত্রী নিয়োগ করা।
সূর্যবাবু এ দিন বলেন, “কয়েক মাস আগে শিশু-মৃত্যুর সময় যা বলেছিলাম, এখনও তা-ই বলছি। এ নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। করা উচিতও নয়। এ বারের ঘটনার সময় মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন। কালীপুজো, ভাইফোঁটা এগুলি সুসম্পন্ন হয়ে গিয়ে থাকলে তাঁর তরফে কোনও বিবৃতি আশা করা যায়। সরকার কী করছে, কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, মানুষ তা জানতে চান।” প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “রাজনীতির ব্যাপার এটা নয়। বাম জমানাতেও অনেক সমস্যা ছিল। কিছু কাজ করতে পেরেছিলাম। কিছু পারিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন, পূর্ণ সময়ের এক জন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রীর কাজের চাপ অনেক। তবে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার অধিকারী আমি নই। উনিই বিবেচনা করবেন।” |
বিসি রায় হাসপাতালে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
প্রসঙ্গত, রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন শিশু-মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “বিষয়টি উদ্বেগের। রাজ্য সরকার বিষয়টি দেখছে।” শিশু-মৃত্যুর কারণ খুঁজতে তদন্ত করা উচিত কি? প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যপাল বলেন, “তদন্তের চেয়েও আমাদের বেশি করে আমাদের দেখা উচিত, যেন একটিও শিশুর মৃত্যু না হয়। রাজ্য সরকার ব্যাপারটি দেখছে।”
ঘটনাচক্রে, রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেশখালিতে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দাবি করেন, মাত্র চার মাস আগে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে মমতার সরকার শিশু-মৃত্যুর হার ৫ শতাংশ কমিয়েছে। যার জবাবে সূর্যবাবু বলেন, “ন্যাশনাল স্যাম্পল রেজিস্টার থেকে গত চার মাসের তথ্য আসতে এখনও দেরি আছে। এর মধ্যেই যাঁরা সুদীপবাবুকে ওই তথ্য দিয়েছেন, তাঁদের কৈফিযৎ চাওয়া উচিত ওঁর।” সুদীপবাবু এ দিনও শিশু হাসপাতালে ৪০ শয্যার ‘সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিটের’ উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, “অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে শিশু-মৃত্যুর হার অনেক কম। তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। ওই হার আরও কমানোই আমাদের লক্ষ্য। এই হাসপাতালের পরিকাঠামো এখন অনেক উন্নত।”
সুদীপবাবু হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পরেই বিজেপি সাংসদ স্মৃতি, দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়-সহ পাঁচ নেতা সেখানে গিয়ে বলেন, “এই রাজ্যে এখনই এক জন পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দরকার। এই হাসপাতালের অবস্থা খুবই করুণ। সাধারণ পরিষেবাগুলিই নেই। ওয়ার্ডের সামনে আবর্জনা। কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার এসেছে পাঁচ মাস হয়ে গেল। এখানে অন্তত কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।”
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবশ্য দাবি, মহারাষ্ট্রে শিশু-মৃত্যুর হার এ রাজ্যের তুলনায় বেশি। এ রাজ্যে যেখানে বার বার শিশু-মৃত্যু ঘটছে, সেই বি সি রায় শিশু হাসপাতাল প্রধানত ‘রেফারাল’ হাসপাতাল। অর্থাৎ, জেলা হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসাধীন যে সব শিশুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় এবং সেখানে আর চিকিৎসার সুযোগ থাকে না, তাদেরকেই প্রধানত এখানে পাঠানো হয়। সেখানে শিশু-মৃত্যু হলেই বিরোধীরা প্রচারে তাকে ‘হাতিয়ার’ করে। ফ্রন্টের আমলে যেমন করছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। এখন তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে করছে সিপিএম।
শিশু-মৃত্যু সমস্যা সমাধানে সুদীপবাবুর বক্তব্য, “শহরের পাশাপাশি জেলা হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোয় নজর দেওয়া দরকার। শিশুরা নানা জায়গায় ধাক্কা খেয়ে যখন বি সি রায়ে পৌঁছয়, তখন আর কিছু করার থাকে না। তাই জেলা হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোর উন্নতি দরকার। যাতে সেখানেই দ্রুত ওই শিশুদের চিকিৎসা করা যায়।
নতুন ইউনিটে জন্মের পর থেকেই মুমূর্ষু শিশুদের রাখা হবে। ৪০ শয্যার মধ্যে ১০টি হবে তুলনামূলক ভাবে সুস্থ সদ্যোজাতদের জন্য। সুদীপবাবু জানান, বাঙুর হাসপাতালেও ৩০ শয্যার এমনই ইউনিট খোলা হবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে প্রতি এক হাজারে শিশু-মৃত্যুর হার ৩৩। সেখানে ওই হার মধ্যপ্রদেশে ৬৭, ওড়িশায় ৬৫, উত্তর প্রদেশে ৬৬ এবং অসমে ৬১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র পক্ষ থেকে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ২৮ এর নিচে নামানোর কথা বলা হয়েছে। আমরা খুব দ্রুতই এই লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।” |