কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, তার বাইরে কোনও প্রস্তাব এলে কঠোর হওয়ারই বার্তা দিল রাজ্য সরকার।
ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটি গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তথা জিটিএ গঠন নিয়ে। কিন্তু রবিবার মংপংয়ে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের পাঁচ নেতার সঙ্গে বৈঠক করে তরাই-ডুয়ার্সকে পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করতে জিএটিএ (গোর্খাল্যান্ড অ্যান্ড আদিবাসী টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। এই প্রসঙ্গে সোমবার প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বলেন, “সরকারি ভাবে আমরা এখনও কিছু জানি না। সংবাদমাধ্যমে ও গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে যেটুকু জেনেছি। কেন্দ্র-রাজ্য ও মোর্চা সহমত হওয়ার পরে জিটিএ চুক্তি হয়েছে। আমরা সেই চুক্তি অনুযায়ী চলতে বাধ্য।” মুখ্যসচিবের ওই ঘোষণাতেই স্পষ্ট, জিটিএ চুক্তিতে যা রয়েছে, তার বাইরে কোনও পদক্ষেপ করতে রাজি নয় রাজ্য। ক্ষমতায় আসার পরই পাহাড়ের সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিটিএ গঠনের লক্ষ্যে সুকনায় যে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়, সেখানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। তখনই ঠিক হয়, তরাই-ডুয়ার্সের যে ১৯৬টি মৌজা জিটিএ-র আওতায় আনার দাবি তুলেছেন গুরুঙ্গরা, তা খতিয়ে দেখতে বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি পাহাড় এবং ডুয়ার্স সফরের সময় ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাস্তবে এই দাবি মানা সম্ভব নয়। এখন আদিবাসীদের একাংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুরুঙ্গ যে জিএটিএ-র প্রস্তাব আনলেন, তাতে পুরো পরিস্থিতি নতুন করে ধাক্কা খাবে বলেই বেশির ভাগের আশঙ্কা। এক দিকে পাহাড়-সমতলের সঙ্গে সিপিএম-সহ রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলই এর বিরোধিতায় নেমে পড়েছে। অন্য দিকে, ঘরে-বাইরে বিপাকে পড়েছেন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পো, ডুয়ার্স শাখার সভাপতি জন বার্লা-সহ ওই পাঁচ প্রথম সারির নেতা। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকে ৩ নভেম্বর তাঁদের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। জিটিএ-তে তরাই-ডুয়ার্সের কোনও অংশ অন্তর্ভুক্ত হলে তার বিরোধিতায় পরিষদের সঙ্গে যে ২১টি সংগঠন সামিল হয়েছিল, তারাও এর মধ্যে পৃথক আন্দোলনে নামার কথা ঘোষণা করেছে। মোর্চা এবং আদিবাসী পরিষদের একাংশের এই দাবির জেরে পাহাড় ও ডুয়ার্সের পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। তিনি এ দিন বলেন, “আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সবাই বা সামগ্রিক ভাবে আদিবাসীরা এই প্রস্তাব সমর্থন করেন না। পাহাড়েরও সব মানুষ এই দাবি মেনে নেবেন না। এ ভাবে আদিবাসীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এর সমাধান অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।” বিরোধী দলনেতা অবশ্য স্পষ্টই বলেছেন, রাজ্য সরকার বিপাকে পড়ুক, তা তাঁদের কখনওই কাম্য নয়। সূর্যবাবুর মন্তব্য, “যে প্রশ্নে বিভাজন ছিল না, সেই প্রশ্নেও বিভাজন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়।” |
সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকেও উত্তরবঙ্গের নেতারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, এই ঘটনার জন্য দায়ী মুখ্যমন্ত্রীই। কারণ, তিনিই শ্যামল সেনের নেতৃত্বাধীন কমিটির কাছে তরাই-ডুয়ার্সের নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির জন্য গুরুঙ্গদের আবেদন জমা দিতে বলেছিলেন। পরে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হবে, তিনি বিষয়টি কী ভাবে দেখছেন। তার পরে আমরা আমাদের অবস্থান জানাব।” গুরুঙ্গের সঙ্গে বৈঠক করে যথেষ্টই প্যাঁচে পড়েছেন আদিবাসী পরিষদের পাঁচ নেতা। তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন তাঁদেরই সংগঠনের নানা ব্লকের নেতা-কর্মীদের একাংশ। তাঁদের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করা না হলে দল ছেড়ে ফের নতুন সংগঠন গড়ার হুমকি দিয়েছেন একাধিক ব্লকের পরিষদের নেতা-কর্মীরা।
ঘটনা হল, এর আগে মোর্চা ঘনিষ্ঠতার দায়ে বিক্ষোভের মুখে পড়ে দল ছাড়তে বাধ্য হন রাজেশ লাকড়া এবং কিরণ কালিন্দী। এখন ফের মোর্চা ঘনিষ্ঠতার প্রশ্নে দলে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দেওয়া উদ্বিগ্ন সংগঠনের অনেকেই।
কিন্তু কী বলছেন ওই পাঁচ নেতা?
পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পো বলেছেন, “মোর্চার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি সময়াভাবে দলের সভাপতিকে জানাতে পারিনি। এতেই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সে জন্য উনি আমাদের অভিভাবক হিসেবে বকতেই পারেন। ভর্ৎসনা করতেই পারেন। আশা করি, ওঁকে বোঝাতে পারব।”
বিমল গুরুঙ্গদের সঙ্গে তাঁদের হাত মেলানোর পিছনে কি ‘গোপন বোঝাপড়া’ রয়েছে? এই অভিযোগে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ রাজ্য সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পো ও জন বার্লা। জন বার্লা বলেন, “এ সব ফালতু অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দাবি নাকচ করে দেন। তাই আমরা মোর্চার সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হয়েছি। কারণ, আমাদের টানা আন্দোলন চালানোর মতো ক্ষমতা নেই। নেই অর্থবল।” শ্যামল সেনের কমিটির কাছে তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসীদের জন্য পৃথক আদিবাসী টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এটিএ) গড়ার দাবি পেশ করবেন বলেও জানালেন তাঁরা। কিন্তু, এত দিন তো মোর্চার সঙ্গে হাত মেলালেই পরিষদের শীর্ষ নেতারা সরব হয়েছেন। তা হলে আজ তাঁরা সেই রাস্তায় হাঁটছেন কেন? জবাবে জন বার্লা বলেছেন, “আগে যাঁরা মোর্চার সঙ্গে গিয়েছেন, তাঁরা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের সঙ্গে তরাই-ডুয়ার্সের সংযুক্তির কথা বলেছিলেন। কিন্তু, মোর্চা গোর্খাল্যান্ডের অবস্থান থেকে সরে জিটিএ গড়ায় আমরা ওদের সঙ্গে গিয়েছি। ওঁরা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে গেলে আমরা ফের সরে আসব।”
রবিবার মংপংয়ে গুরুঙ্গের ঘোষণার রেশ পড়েছে পাহাড়েও। জিটিএ গঠনের পরে পাহাড়ে উন্নয়নের গতি আনতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী যেখানে উদ্যোগী হয়েছেন, সেখানে এমন সিদ্ধান্তে জটিলতার সৃষ্টি হবে বলে পাহাড়বাসীদের অনেকেই মনে করছেন। এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে মোর্চার মধ্যেও। তবে মোর্চা আপাতত সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাইছে না। দলের প্রচার সচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেন, “আপাতত এ নিয়ে কিছু বলার নেই। যা বলার দলের সভাপতি বলেই দিয়েছেন। প্রয়োজনে আবার সভাপতিই বলবেন।” |