|
|
|
|
কলঙ্কিত নেতাদের ছেঁটে শুদ্ধকরণ শুরু সিপিএমে |
রঞ্জন সেনগুপ্ত • কলকাতা |
দলের ‘কালিমালিপ্ত’ ভাবমূর্তির নেতাদের এ বার ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়ায় হাত দিল সিপিএম। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের আর নতুন কমিটিগুলিতে না-রাখার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
সম্মেলন-পর্বের আগে (আগামী ৯ নভেম্বর থেকে লোকাল স্তরে সম্মেলন শুরু) সিপিএমের রাজ্য কমিটির শেষ বৈঠকে দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় থাকা নেতাদের নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়েছে বলেই আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর। কয়েক জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুও করে দেওয়া হয়েছে। আসন্ন সম্মেলনে নতুন কমিটি গড়ার সময় ওই ‘কলঙ্কিত’ নেতাদের আর জায়গা দেওয়া হবে না বলেই ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আলিমুদ্দিন। এই তালিকায় যেমন এক কালের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সাংসদ আছেন, তেমনই আছেন কয়েক জন জেলা সম্পাদকও। কমিটির কলেবর ছোট করে তার ‘গুণগত মান’ বাড়াতে চাইছেন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। এমনিতেই নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে সিপিএমের মধ্যে ‘সুবিধাবাদী’ অংশটি দল ছেড়ে যাচ্ছে। বহুচর্চিত ‘শুদ্ধকরণে’র জন্য এই ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’কে ব্যবহার করতে চাইছে আলিমুদ্দিন।
লক্ষ্মণ শেঠ |
দলের ভাবমূর্তি ‘পরিচ্ছন্ন’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা রাজ্য কমিটির জবাবি ভাষণে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। লোকাল ও জোনাল কমিটির ক্ষেত্রে সদস্যদের ‘সততা, গ্রহণযোগ্যতা, নিয়মনিষ্ঠা, যোগ্যতা ও গতিশীলতা’কেই ‘মানদণ্ড’ করার কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘কমিউনিস্ট নৈতিকতা’র বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। এ ছাড়া, নতুন কমিটি গঠনের সময় ২৫% নতুন ও অপেক্ষাকৃত তরুণদের জায়গা দেওয়ার ‘সূত্র’বেঁধে দিয়ে বিমানবাবু বলেছেন, কমিটির আয়তন যথাসম্ভব ছোট রাখা হবে এ বার।
সিপিএম সূত্রের খবর, উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে হলদিয়ার প্রাক্তন সাংসদ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য লক্ষ্মণ শেঠের উপরে শাস্তির খাঁড়া ঝুলছে। তাঁর কর্তৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আওতায় একই বাড়িতে যে ভাবে দু-দু’টি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই ‘অনৈতিক আচরণ’কে একেবারেই ভাল চোখে নেননি রাজ্য নেতৃত্ব। রাজ্য পার্টি কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত চিকিৎসকদের সেল-কে দিয়ে লক্ষ্মণবাবুর সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগের নিজস্ব তদন্ত করিয়েছে আলিমুদ্দিন। সেই তদন্তের রিপোর্ট একেবারেই প্রাক্তন সাংসদের বিরুদ্ধে।
সেই রিপোর্ট দেখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর লক্ষ্মণবাবুকে রাজ্য কমিটিতে ফেরানোর পক্ষপাতী নন বলেই সিপিএম সূত্রের খবর। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আলোচনার পরে রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু প্রাক্তন সাংসদকে শো-কজও করেছেন। আলিমুদ্দিনের ‘বার্তা’ পড়ে নিয়েই লক্ষ্মণবাবু রবি ও সোমবারের রাজ্য কমিটির বৈঠকে আসেননি বলে সিপিএমের একাংশের ব্যাখ্যা। যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, লক্ষ্মণবাবু তাঁর ওই সংস্থাকে নিয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়ার জন্য রাজ্যের বাইরে ছিলেন।
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডেই ভাবমূর্তি ‘কলঙ্কিত’ হয়ে-যাওয়া লক্ষ্মণবাবুর বিধানসভায় টিকিট পাওয়া আটকাতে বুদ্ধবাবু দলের অন্দরে সক্রিয় হয়েছিলেন। এ বার সম্মেলনের আগেও তিনি ‘সক্রিয়’। কিন্তু ‘শুদ্ধকরণে’র পর্বে বুদ্ধবাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত যাদবপুরের নেতারা সিপিএমের ছাঁকনি থেকে বাদ পড়ছেন না। ওই এলাকার প্রাক্তন বরো চেয়ারম্যান স্বপন (সমরেন্দ্রনাথ) রায়কে দলের যাবতীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গিয়েছে। এ বার কোপ পড়তে চলেছে যাদবপুরে বুদ্ধবাবুর ‘ভোট ম্যানেজার’ বলে পরিচিত এক নেতার উপরেও। প্রোমোটারি, ঠিকাদারিতে মদত-সহ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে কমিশন করার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ হয়ে গিয়েছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর।
একই ভাবে দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার সম্পাদকের বিরুদ্ধেও আর্থিক কেলেঙ্কারি, ‘সশস্ত্র বাহিনী’ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ভূরি ভূরি অভিযোগ আছে। লক্ষ্মণবাবু শাস্তি পেলে ওই নেতা কেন বাদ যাবেন, এই প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরে। এই অভিযোগের বিষয়টি আপাতত বিবেচনায় রেখেছেন রাজ্য নেতৃত্ব। কয়লা-মাফিয়াদের টাকায় দলের নামে বৈভব গড়ে তোলার অভিযোগে এক জেলা সম্পাদকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন রাজ্য কমিটি এবং ওই জেলার একাধিক নেতা। পরবর্তী কমিটিতে তাঁকে আর না-রাখার ব্যাপারেও ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কঙ্কাল-কাণ্ডে প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের পাশেই দাঁড়িয়েছে আলিমুদ্দিন। কিন্তু দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েও তিনি যে ভাবে নানা জায়গায় বিপুল সম্পত্তি করেছেন, তা নিয়ে দলীয় স্তরে তদন্তের দাবি তুলেছেন দলের একাংশ।
শুধু আর্থিক দুর্নীতিই নয়, ‘নৈতিক অবস্থান এবং জীবনযাপনের ধরনে’ যাঁরা দলের চেনা আদর্শের পথে থাকছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেও কড়া অবস্থান নেওয়ার দাবি উঠেছে রাজ্য কমিটিতে। এ বারের বৈঠকেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে দলের এক সাংসদকে ঘিরে। শাসক দলের প্রবল ‘আক্রমণে’র মুখে বহু জায়গায় ‘গোপনে’ সম্মেলন করার মতো ‘গুরুতর’ বিষয়ে আলোচনার সময় ওই সাংসদ তাঁর মোবাইলে একটি সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট খুলে রেখেছিলেন! বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এক প্রস্ত হইচই হয় বৈঠকেই। এই ধরনের জীবনচর্যায় অভ্যস্ত নেতাদের কেন দলীয় কমিটিতে রাখা হবে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই। |
|
|
|
|
|