|
|
|
|
সমস্যা শুনলেন ‘ইতিবাচক’ মুখ্যমন্ত্রী |
আলিমুদ্দিনকে অস্বস্তিতে ফেলে মহাকরণে রেজ্জাক |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দল তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়েই বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনায় পড়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে তাঁর আলটপকা মন্তব্যের জন্য তাঁকে ‘ভর্ৎসনাও’ করা হয় দলের অন্দরে। তাঁকে ঘিরে আলিমুদ্দিনের যে বরাবরের ‘অস্বস্তি’, সোমবার তা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা সম্পূর্ণ ‘নিজস্ব উদ্যোগে’ মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে।
প্রত্যাশিত ভাবেই, রেজ্জাকের দিকে ‘ইতিবাচক’ হাত বাড়িয়েছেন মমতাও। যে সমস্যা নিয়ে সিপিএমের ‘দাপুটে নেতা’ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন, তা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই যে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসন এবং দলকে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তা জানিয়েছেন রেজ্জাক নিজেই।
তবে যে ভাবে দলের রাজ্য কমিটির বৈঠক শেষের পরে কালক্ষেপ না-করেই ‘নিজস্ব উদ্যোগে’ রেজ্জাক মমতার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন, তাতে যে আলিমুদ্দিন যথেষ্ট ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছে, তা দলের একাংশই স্বীকার করছেন।
‘নিজস্ব উদ্যোগ’, কারণ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেছেন, তিনি রেজ্জাকের মহাকরণ-অভিযানের বিষয়টি জেনেছেন সংবাদমাধ্যম থেকে। রেজ্জাকের অবশ্য দাবি, তিনি দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে জানিয়েই মমতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। দলের অনুমতি নিয়েছেন কিনা, প্রশ্ন করায় প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী রাতে বলেন, “অবশ্যই নিয়েছি। আমি একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ দল করি। আমি কি পাগল, যে দলের অনুমোদন না নিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করব? অনুমোদন নিয়েই একজন বিধায়ক হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি।” |
|
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে বেরোচ্ছেন সিপিএম
বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা। সোমবার মহাকরণে। ছবি: রাজীব বসু |
এ দিন মহাকরণে মমতার সঙ্গে বৈঠকের অব্যবহিত পরেই দলীয় অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করায় রেজ্জাক অবশ্য বলেছিলেন, “আমি বিধায়ক। উনি মুখ্যমন্ত্রী। বিধায়ক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অধিকার আমার আছে। এর জন্য দলের অনুমতি নিতে হবে কেন?” উল্টে বরং তখন তাঁর প্রশ্ন ছিল, “দলের অনুমতি নিয়ে কেউ কি ছেলের বাপ হয়?” বামফ্রন্টের সঙ্গে না-এসে একলা কেন? রেজ্জাক স্বভাবসিদ্ধ মেজাজেই জানান, বিভিন্ন কারণে বামফ্রন্ট দলগত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসেছে। তিনি এসেছেন বিধায়ক হিসেবে এলাকার
কিছু মানুষের সমস্যা নিয়ে। সকলের সমস্যা দেখা তাঁর কাজ নয়। বিমানবাবু তাঁর সাক্ষাতের বিষয় জানেন কিনা, মহাকরণে সে প্রশ্নেরও জবাব দেননি ‘বিতর্কিত’ সিপিএম নেতা।
মহাকরণে তিনি ‘অন্য রকম’ বললেন কেন? জবাবে রেজ্জাক বলেন, “কিছু সাংবাদিক বার বার দলের অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন। তাঁরা আমাদের দলের অনুশাসন সম্পর্কে জানেন না। তাই ও কথা বলেছি!”
প্রসঙ্গত, এর আগে কথা দিয়েও দলের বারণ থাকায় সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের একটি কনভেনশনে যাননি রেজ্জাক। না-যাওয়ার কারণ জানিয়ে এবং কনভেনশনের উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর ‘সমর্থন’ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রেজ্জাক যাওয়ায় কোনও ‘অসুবিধা নেই’ বলে দাবি করেছেন সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “দলীয় বিধায়করা মানুষের প্রয়োজনে সরকারি দফতরে বা মন্ত্রীদের কাছে যাবেন, এটাই আমাদের নীতি।” ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে রেজ্জাক মমতার কাছে গিয়েছিলেন ভাঙড় এলাকার সিপিএমের ‘ঘরছাড়াদের’ ঘরে ফেরাতে অনুরোধ জানাতে। প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হয়। বৈঠকের পরে রেজ্জাক বলেন, “আমার এলাকায় কয়েকটি সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলাম। সেই প্রসঙ্গেই আজ কথা বলতে এসেছিলাম। ওঁর মনোভাব খুবই ইতিবাচক ছিল।’’ রেজ্জাকের কথায় স্পষ্ট যে, মমতার সঙ্গে কথা বলে তিনি ‘খুশি’। বস্তুত, ‘খুশি’ হওয়ার কথা মমতারও। যে ভাবে রেজ্জাককে ‘ইতিবাচক’ মনোভাব দেখিয়ে তিনি সিপিএমের অন্দরের ‘বিভাজন’ উস্কে দিতে পেরেছেন, তা নিয়ে আলিমুদ্দিনের ‘উদ্বেগ’ বাড়ারই কথা। এর আগে একাধিক বার সিপিএম আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই বিষয়ে প্রশাসনের কাছে ‘ঘরছাড়াদের’ ফেরাতে আর্জি জানিয়েছে। ‘কাজের কাজ’ কিছু হয়নি, দাবি তাদের। কিন্তু এ দিন রেজ্জাকের অনুরোধ পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি প্রশাসন ও দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের ওই বিষয়ে ‘উদ্যোগী’ হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রেজ্জাকের দাবি, বিধানসভা ভোটের পর থেকে তাঁদের দলের ৮৩ জন কর্মী-সমর্থক ঘরছাড়া। তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং এঁদের অধিকাংশই নির্বাচনের সময় তাঁর হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন। ঈদের আগে যাতে তাঁরা ঘরে ফিরতে পারেন, তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। রেজ্জাকই জানান, মুখ্যমন্ত্রী সব কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও তাঁর দলকে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
কৃষিজমির পাট্টা নিয়েও মমতা-রেজ্জাক আলোচনা হয়। প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী রেজ্জাক পরে জানান, জমির পাট্টা কার, সেটি পরে বিচার্য। কিন্তু ওই সব জমিতে যাঁরা কৃষি কাজ করছেন, তাঁদের যেন কাজ করতে দেওয়া হয়। এই বিষয়েও মুখ্যমন্ত্রী সব রকম ‘সহযোগিতার’ আশ্বাস দিয়েছেন বলে রেজ্জাক জানিয়েছেন। কৃষিজমি যাতে কৃষিকাজেই ব্যবহার করা হয়, সেই মর্মে বাম আমলের ভূমিমন্ত্রী একটি বিলের খসড়া তৈরি করেছিলেন। যা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনদের কাছে বিশেষ ‘মূল্য’ পায়নি। যুক্তি ছিল, নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের হাতে খসড়া পৌঁছেছে। তখন ‘কাজের কাজ’ কিছু হবে না। রেজ্জাক খসড়ার একটি প্রতিলিপিও মুখ্যমন্ত্রীকে দেন। খসড়া অনুযায়ী, কেউ কৃষি জমি কিনলে সেখানে চাষবাসই করতে হবে। কৃষি ছাড়া অন্য কাজ করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ঘটনাচক্রে, রেজ্জাকের মহাকরণ-সফর নিয়ে ‘অন্যায়’ কিছু না-দেখলেও রেজ্জাক জমি সংক্রান্ত বিলের ব্যাপারে মমতাকে যা বলেছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তাঁর জেলা সম্পাদক সুজনবাবু।
মমতার সঙ্গে তাঁর দেখা করা নিয়ে যে আবার ‘কৌতূহল’ তৈরি হবে, তা নিয়ে নিঃসন্দেহ রেজ্জাক (দলের একাংশের মতে, তিনি নিজেও তা-ই চান)। রেজ্জাকের কথায়, “দলে কোথাও বলা নেই, প্রয়োজনে কোনও বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। বরং প্রয়োজনে আমরা তাঁদের কাছে যাব, এটাই আমাদের নীতি। সেই মতোই গিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে অহেতুক কথা হচ্ছে।” তাঁর কাছে কোনও অভ্যাগত গেলেই মমতা তাঁকে ঘর থেকে মহাকরণের করিডর পর্যন্ত এগিয়ে দেন। রেজ্জাকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ সব ক্ষেত্রে নমস্কার এবং প্রতি-নমস্কারই প্রথা। তবে এ দিন আপাত-বিরল এক ‘হাত মেলানোর দৃশ্য’ দেখা গিয়েছে রেজ্জাক-মমতার মধ্যে। যা থেকে ‘জল্পনা’ আরও তীব্র হয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। আলিমুদ্দিনে তীব্রতর হয়েছে ‘অস্বস্তি’। |
|
|
|
|
|