এ বার তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসীদের গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ বা জিটিএ-তে সামিল করতে আসরে নামলেন বিমল গুরুঙ্গ।
রবিবার সেবক লাগোয়া মংপংয়ে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের পাঁচ শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। বৈঠকের পরে তিনি জানান, জিটিএ পুনর্গঠনের জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানানো হবে। তাতে তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসী-সহ সমস্ত সম্প্রদায়ের বাসিন্দাকে সামিল করার প্রস্তাব দেবে মোর্চা। মোর্চা ও পরিষদের নেতাদের একাংশের যৌথ ঘোষণার বিষয়টি নজরে এসেছে রাজ্য সরকারের। তবে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “এ ব্যাপারে কোনও প্রস্তাব সরকারের কাছে আসেনি। কাজেই এখনই মন্তব্য করা সম্ভব নয়।”
এ দিন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে গুরুঙ্গ বলেন, “পাহাড়ের মতো তরাই-ডুয়ার্সও বঞ্চিত। কাজেই ঝগড়া না করে আমাদের একসঙ্গে এগোতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীও মিলেমিশে থাকার উপরে জোর দিচ্ছেন। জিটিএ-এর নাম বদলে গোর্খাল্যান্ড-আদিবাসী টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএটিএ) করলে পরিষদের আপত্তি নেই।” জিটিএ-র সীমানা বৃদ্ধির দাবি খতিয়ে দেখবে বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বাধীন কমিটি। এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুঙ্গের বক্তব্য, “সমীক্ষার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেন্দ্রের কাছে জিএটিএ গঠনের আর্জি পেশ করব। এখন সমীক্ষার কাজে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেই ব্যাপারে সকলে মিলে খেয়াল রাখব।”
পরিষদের ডুয়ার্স শাখার সভাপতি জন বার্লাও গুরুঙ্গের সঙ্গে একই সুরে জানান, গোর্খা ও আদিবাসীরা তরাই-ডুয়ার্সের সীমানা নিয়ে আর ‘দ্বন্দ্বে’ যাবে না। তিনি বলেন, “জিএটিএ গঠন করে উভয় সম্প্রদায় যাতে নিজস্বতা বজায় রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”
তবে পরিষদের রাজ্য সভাপতি বিরসা তিরকে এবং ২২টি সংগঠনকে নিয়ে গঠিত তরাই-ডুয়ার্স মুভমেন্ট কমিটির অধিকাংশ নেতা মংপংয়ের বৈঠকের কথা ‘জানেন না’। বিরসাবাবু বলেন, “যেখানে জিটিএ গঠিত হয়েছে, সেখানে এ সব আলোচনার কোনও মানে নেই। গুরুঙ্গদের তা আগেই বলেছি। মংপংয়ে কী আলোচনা হয়েছে, খোঁজ নেব। তার পরে যা বলার বলব।”
গুরুঙ্গরা তরাই-ডুয়ার্সের ১৯৬টি মৌজাকে জিটিএ-এর আওতায় আনার দাবি করলে গোড়া থেকেই তার বিরোধিতা করছে পরিষদ। তার প্রতিবাদেই গড়ে উঠেছে তরাই-ডুয়ার্স মুভমেন্ট কমিটি। সেই কমিটির কার্যকরী সভাপতি ল্যারি বসুর আশঙ্কা, জিএটিএ গঠনের প্রস্তাবে পরিস্থিতি জটিল হবে। ল্যারিবাবু বলেন, “পরিষদের জন বার্লা কমিটির
আহ্বায়ক। কিন্তু এই বৈঠক নিয়ে তিনি আমাদের কিছু জানাননি। এতে তরাই-ডুয়ার্সে শান্তির পরিবেশ নষ্টের আশঙ্কা রয়েছে।” জানালেন, তাঁরা শীঘ্রই কমিটির বৈঠক ডাকবেন। পরিষদের রাজ্য সম্পাদক তেজ বাহাদুর টোপ্পো জানিয়েছেন, আগামী দিনে তিনি কমিটির সদস্যদের বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন। |
বস্তুত, গুরুঙ্গদের দাবি খতিয়ে দেখতে কমিটি গড়লেও তা যে বাস্তবে মানা সম্ভব নয়, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি পাহাড়ে গিয়ে তিনি বলেছেন, পাহাড় পাহাড়ের মতো থাকবে। ডুয়ার্সে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘কেউ কাকে কান নিয়ে গিয়েছে বললেই ভয় পাওয়ার কারণ নেই’। জানিয়েছেন, তরাই-ডুয়ার্স থাকবে তরাই-ডুয়ার্সের মতোই। এমনকী, পরিষদ তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাকে ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার দাবি তুললেও তা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী। তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে তাদের যা দাবি, তা সেন কমিটির কাছে জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এই অবস্থায় পরিষদের একটি বড় অংশের সঙ্গে মোর্চা নেতাদের এ হেন সমঝোতা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন পাহাড়-সমতলের অনেক রাজনৈতিক নেতাই। পাহাড়ের একাধিক রাজনৈতিক দল মনে করছে, বিজনবাড়ি-কাণ্ডের পরে ঘরে-বাইরে যে ক্ষোভ ও বিতর্ক দানা বাঁধছে, তা চাপা দিতেই আদিবাসীদের পাশে নিয়ে গুরুঙ্গ আচমকা জিটিএ পুনর্গঠনের ঘোষণা করেছেন।
নানা কাজকর্মের জেরে যে পাহাড়ে মোর্চার সংগঠন দুর্বল হচ্ছে, সে কথা উল্লেখ করেছেন সিপিআরএমের যুব সংগঠনের সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অরুণ ঘাটানি। তিনি বলেছেন, “বিজনবাড়ি দুর্ঘটনার পরে তো অনেকেই মোর্চা নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। ওই দুর্বল সেতুতে লোক চলাচল নিয়ন্ত্রণে মোর্চা নেতারা কেন যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেননি, সেই প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি।” তাঁর বক্তব্য, “এ সব প্রশ্ন চাপা দিতেই হয়তো আচমকা আদিবাসীদের নিয়ে জিএটিএ গঠনের কথা ফলাও করে বলা হচ্ছে।”
অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগের সহ-সভাপতি লক্ষ্মণ প্রধান বলেন, “জিটিএ-এর বদলে জিএটিএ গঠনের প্রস্তাব দিয়ে গোটা প্রক্রিয়াটা গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।” তিনি আরও মনে করছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘনঘন যাতায়াতে পাহাড়-সমতলে যে শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট হতে পারে।” জিএনএলএফের এক প্রবীণ নেতা অবশ্য মনে করেন, তরাই-ডুয়ার্সে মৌজা নিয়ে সমীক্ষার সময়ে সেন কমিটি যাতে বিরোধিতার মুখে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই এই সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন মোর্চা নেতৃত্ব। মোর্চা সভাপতি অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমরা দলে আলোচনা করেই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সিপিএমের তরফে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, “মংপংয়ের ঘোষণার কথা শুনেছি। রাজ্য সরকার কী প্রতিক্রিয়া জানায় দেখি। দলেও আলোচনা করি। তার পরে যা বলার বলব।” |