বেড়ালটা একা বসে থাকে জানলার ধারে।
তার মা কোথায় সে জানে না।
লোকে বলে, মাকে শহর থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মা তাই লুকিয়ে আছে অন্য কোথাও।
বেড়ালটাকে মা ডাকত মিনু বলে। ভাল নামও একটা ছিল-বাঘিনি।
আর এই বেড়ালটাকে নিয়েই তাঁর পরের ছবি করছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
এবং এই বেড়ালটা তসলিমা নাসরিনের।
“তসলিমার মেয়ে ও। তসলিমাকে যখন এই শহর প্রত্যাখান করল, ২০০৭-য়ে, তখন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় মিনুর ছবি ছাপা হয়েছিল। একা বসে আছে। মা’র অপেক্ষায়। সে দিন থেকে ব্যক্তি তসলিমার কষ্টের দিকটা আমায় তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। তাই এই ছবির নায়িকা ওই বেড়ালটাই। তসলিমা না।” বলছেন কৌশিক।
তাঁর আরও বক্তব্য, “তসলিমার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটা বানাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু তসলিমার বিতর্কিত দিকগুলো বাদ দিয়ে। কেন না উনি একটা বিশ্বাসের আবর্তে বাঁচেন। আমি সচেতনভাবে সেই আবর্ত থেকে দূরে থাকছি। তসলিমার ব্যক্তিগত কষ্টের একটা দিককে এই ছবিতে তুলে ধরছি মাত্র। যে কষ্টটা মানুষ হিসেবে আমাকে নাড়া দিয়েছে।” |
মিনুর সঙ্গে নিজের বাড়িতে। ফাইল চিত্র |
যে নাড়া থেকে জন্ম নিয়েছে ছবির মূল বিষয়একদিকে মা তসলিমা আর তাঁর মেয়ে মিনু। অন্যদিকে তসলিমার মা আর তসলিমা। এঁদের মধ্যে বিচ্ছেদের সমান্তরালে উঠে এসেছে মা আর সন্তানের সম্পর্কের চিরকালীনতা। ভিটে ছাড়া হওয়ার, প্রিয়তম মানুষটাকে দেখতে না পাওয়ার বেদনা। রাজনীতি, মৌলবাদ, পিতৃতন্ত্র অর্থাৎ তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শব্দগুলো থেকে বেরিয়ে ব্যক্তি তসলিমার কষ্টগুলো তুলে ধরতে চাওয়া এই ছবির নাম ঠিক হয়েছে ‘নির্বাসন’।
চার মাস আগে ডাকে তসলিমাকে চিত্রনাট্যটা পাঠিয়েছিলেন কৌশিক। আশা করেননি তসলিমার একবারেই এতটা পছন্দ হয়ে যাবে। এর পর নিউইয়র্ক থেকে উড়ে এসে দিল্লির অজ্ঞাত আস্তানায় বসে চিত্রনাট্য নিয়ে তসলিমা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন কৌশিকের সঙ্গে। “তসলিমা কে করবেন ঠিক হয়নি। বিখ্যাত কাউকে নেব না। তাতে লোকে স্টারকে নিয়েই মাথা ঘামাবে বেশি। যেটা আমি চাই না।” জানাচ্ছেন কৌশিক।
আর তসলিমা বলছেন, “অনেক কষ্ট পেয়েছে মিনু। তা আমার কষ্টের মতো প্রচার পায়নি। কিন্তু ওর একাকিত্ব আমার চেয়ে এক বিন্দু কম যন্ত্রণার ছিল না। আমার মা আমায় ছেড়ে বেঁচেছিলেন আর আমি ছিলাম আমার পালিতা বিড়াল কন্যাকে ছেড়ে। রাজনীতি, ধর্ম নেই সেখানে। শুধু মা-মেয়ের কষ্ট।”
সেই কষ্টের ধরনটা সত্যিই অনেকটা একই রকম।
তসলিমা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ঠাঁইনাড়া হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন সুইডেন থেকে প্যারিস। কোনও শহরেই তাঁর বাসা নেই। আপনজন নেই। পছন্দের খাওয়া দাওয়া নেই। নেই মন খুলে কথা বলার মতো ভাষাটুকু।
মিনুরও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তসলিমাকে রাতারাতি কলকাতা ছাড়তে হল। মিনুকে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তারপর এই শহরে মিনু ঘুরেছে এ বাড়ি, ও বাড়ি। সেখান থেকে বাংলাদেশ। সেখানেও ঠাঁই হয়নি। কেউ কেউ তো তসলিমার বেড়াল বলে ওকে সতীন ঠাওরে বসেছেন। অগ্যতা আবার কলকাতায় ফেরত পাঠানো হল মিনুতে। এই গোটা সময়টা ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করত না মিনু। গুমরে গুমরে থাকত।
ঠিক যেমন তসলিমা থাকতেন তাঁর মা’কে দেখতে না পেয়ে। নিজের বাসা, নিজের ঘরের কোণাটুকু হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু যে শহর ছাড়তে তসলিমাকে বাধ্য করা হল সেই শহরে বসে তাঁকে নিয়ে ছবি করাটা একটু বেশি দুঃসাহসী পদক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে না?
মুচকি হেসে কৌশিক বলছেন, “এটা তো একটা বেড়ালের গল্প। তা নিয়েও কারও আপত্তি থাকবে বলে মনে হয়?”
তবু বিতর্ক এড়াতে এই ছবিকে সরাসরি তসলিমার জীবন বলছেন না তিনি। বলছেন, তসলিমার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হবে মাত্র। বাকিটা নাকি কল্পনাশ্রিত।
তার মানে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ছবি করা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ধাতে নেই? বিতর্কিত বিষয়ের অভাব বাঙালি জীবনে কোনওদিন না থাকা সত্ত্বেও?
সমাজতত্ত্ববিদ বুলা ভদ্র বলছেন, “টালিগঞ্জ ব্যক্তিভিত্তিক ছবি করলেও তাঁদের জীবনের বিতর্কিত দিকগুলোকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে। উল্টে তাঁদের প্রায় দেবত্বে উন্নীত করা হয়েছে এই সব ছবিতে। সে সুভাষ বসুই হোন বা রামকৃষ্ণদেব। তা না হলে সাধারণ মানুষ সেই ছবি দেখতই না। তবে এখন অন্য ধারার ছবিগুলো ভাল বাজার পাওয়ার ফলে অনেক পরিচালক সাহস করে বিতর্কিত মানুষদের জীবন নিয়ে ছবি করতে এগিয়ে আসছেন। ‘আর একটি প্রেমের গল্প’র মতো ছবি তৈরি হচ্ছে। না হলে চপল ভাদুড়ির মতো মানুষের জীবন নিয়ে ছবি করার কথা ভাবাই যেত?”
তা হলে কি বলিউড যে ভাবে সিল্ক স্মিতা (ডার্টি পিকচার্স) থেকে আবু সালেম (গ্যাংস্টার), দয়া নায়েক (অব তক ছপ্পন), বা রবি বর্মা(রং রাসিয়া)-দের একের পর এক পর্দায় তুলে ধরছে টালিগঞ্জও দ্বিধা ঝেড়ে সেই ধারা অনুসরণ করবে?
পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বড় মানুষদের জীবনের বিতর্কিত দিকগুলো পর্দায় এড়িয়ে যাওয়া শুধু বাংলা নয় ভারতীয় চলচিত্ররই বৈশিষ্ট্য। রিচার্ড অ্যাটেনবরো ছাড়া অতটা নিরপেক্ষভাবে ‘গাঁধী’ কোনও ভারতীয়র পক্ষে করা সম্ভব হত কি না সন্দেহ। আর এই যে সব হিন্দি ছবির নাম করলেন সে গুলোও তো হালের। যে কোনও ধারাই পাল্টাতে সময় লাগে। আমার ধারণা বাংলা ছবিতেও আস্তে আস্তে এই ধরনের কাজ দেখা যাবে।”
তবে নামটা তসলিমা বলে কি একটু বেশি সতর্কতার প্রয়োজন?
না হলে মহেশ ভট্টের ‘বিশেষ ফিল্মস’ যারা ‘গ্যাংস্টার’ বানিয়েছিল তারাও তসলিমাকে নিয়ে ছবি বানানোর যাবতীয় কথা সেরে ফেলার পর পিছিয়ে যায়? পিছিয়ে যায় আর একটি বড় প্রযোজনা সংস্থা যারা জেসিকা লাল খুনের মতো চূড়ান্ত বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ছবি করেছিল? ‘নির্বাসন’ প্রযোজনা করতে এগিয়ে এসেছে ব্র্যান্ড ভ্যালু কমিউনিকেশন। সেই সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুন্ডু বলছেন, “বিষয়বস্তু শুনে আমাদের মনে হয়েছে এই ছবি দর্শকদের টানবে। রাজনৈতিক বিতর্ক, মৌলবাদ নিয়ে ভাবতে বসার প্রয়োজন বোধ করিনি।”
মিনু আর মিনুর মা অবশ্য এ সব থেকে অনেক দূরে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।
কলকাতা থেকে ঝুড়িতে চেপে প্লেনে করে মেয়ে যে পৌঁছে গিয়েছে মা’র কাছে!
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এখন তাই ব্যস্ত ‘মিনু’ খুঁজতে। প্রচুর বেড়ালের অডিশন নেওয়া চলছে!
নায়িকা বলে কথা। |