|
|
|
|
ব্যাবিলন দশ মিনিট, গেলে হয় না? |
তখন বসরাই গোলাপ, সিন্দবাদ নাবিক, আরব্য রজনীর মায়া এখন যুদ্ধ, আতঙ্ক,
তছনছ ইরাক। তবুও কৌতূহল জাগানোর সব রসদ নিয়ে হাতছানি দেয়
ঝলমলে বাগদাদ, বসরা, কারবালা, সামারা। মুদার পাথেরিয়া |
এপ্রিল ১৯৮৬। অস্ট্রেলেশিয়া কাপ ফাইনালের শেষ বলে জাভেদ মিয়াঁদাদ চেতন শর্মাকে ছক্কা হাঁকালেন। অতঃপর আমার কী কর্তব্য? স্পোর্টসওয়ার্ল্ড পত্রিকার জন্য ম্যাচ কভার করতে শারজায় গিয়েছিলাম। খেলা শেষ। এ বার আমার সামনে তিনটে রাস্তা। এক, দুবাইতে আয়েস করা। দুই, পরের ফ্লাইট ধরে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরা। তিন, টুক করে ইরাকে ঢুকে পড়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক। তখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলছে।
আমি তিন নম্বর অপশনটায় টিক দিলাম। দুবাই থেকে বাগদাদ ফ্লাইট। বাগদাদ এয়ারপোর্টে একটা ট্যাক্সি নিলাম। যেন আরবি ভাষাটা দিব্যি জানি, এমন ভাব করে বললাম, ‘কারবালা’। ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পরে রাত্রির আকাশে ভেসে উঠল এক সোনালি গম্বুজ। আমার চোখে জল এল। আমি শিয়া মুসলমান। আমরা, শিয়া মুসলমানরা কোনও সঙ্কটে পড়লে বলি, ‘ইয়া হুসেন’। যখন কোনও কারণে আল্লার কাছে মার্জনা চাই, তখন হুসেনকে মধ্যস্থ রাখি। আমাদের বিশ্বাস, আল্লার কাছে সরাসরি মার্জনা চাইলে তিনি হয়তো পাপপুণ্যের খতিয়ানটা খুলে সামনে ধরবেন, কিন্তু হুসেনের আড়ালে থাকলে তিনি বলতে বাধ্য হবেন, ‘মাফ কিয়া’। তাই কারবালা এবং নজফ-এ যাওয়াটা কেবল এক তরুণের দুনিয়া দেখতে চাওয়ার ব্যাপার নয়, আর একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল তার ‘ধন্যবাদ’ বলা। (কারবালায় আছে হুসেনের কবরস্থান, নজফে আলি-র।) কারবালায় যাওয়ার পক্ষে ১৯৮৬ ছিল একটু অদ্ভুত সময়। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। ইরান, দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি শিয়া মুসলমানের বাস যে দেশে। এমনিতে কারবালা-নজফের শতকরা আশি ভাগ তীর্থযাত্রীই আসেন ইরান থেকে। কিন্তু আশির দশক মানে অন্য যুগ, ইরানের মানুষের পক্ষে ইরাকের সীমান্ত পেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য। তাই বেশির ভাগই ইরাকি। তাঁদের অনেকেই এসেছেন কফিন নিয়ে। সেই কফিনের ভিতর শায়িত আছে যুদ্ধে নিহত স্বজনের দেহ। কফিন নিয়ে তাঁরা কারবালা এবং নজফে হুসেন আর আলির কবর প্রদক্ষিণ করেন, তার পর সেটি গোরস্থানে নিয়ে যান।
কালো কাপড়ে ঢাকা মেয়েরা গিয়েছেন সেখানে, প্রায় কারও সঙ্গেই পুরুষ নেই। থাকবে কী করে? পুরুষরা তো যুদ্ধে গিয়েছেন, অথবা মৃত।
শবে-বরাতের দিন, ওঁরা এসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে, পুণ্যভূমিতে বসে আছেন, অপলক চেয়ে আছেন সমাধিস্থলের দিকে। চত্বরে নয় নয় করে হাজার কুড়ি মানুষ। একশো মিটার যেতেও অন্তত কুড়ি মিনিট সময় লাগে। এবং সেই আর্ত ক্রন্দন। হুসেনের, কিংবা একটু দূরে তাঁর ভাই আব্বাসের সমাধিস্থলে গেলে শুনতে পাবেন মেয়েদের কান্না। তাঁরা গ্রিল ধরে কাঁদছেন, বেদনা জানাচ্ছেন, মানত করে ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন। প্রচণ্ড গরম, ধুলো, দারিদ্র...ফেরার পথে বাগদাদে সন্ধেটা কাটালাম। শহর জুড়ে বোমার আওয়াজ। আমার ফ্লাইট সকাল সাতটায়, কিন্তু এগারোটার মধ্যেই এয়ারপোর্ট রওনা হয়ে গেলাম। সেখানে পৌঁছে শরণার্থীর মতোই রাত কাটালাম। চেক-ইন করার দু’ঘণ্টা আগে লাইনে দাঁড়ালাম, ইমিগ্রেশনের পাট চুকিয়েই সোজা দৌড়, কারণ কানাঘুষোয় শুনছিলাম যে ফ্লাইটে যত আসন তার চেয়ে বেশি টিকিট দেওয়া হয়েছে। কায়রোর ফ্লাইট আকাশে উড়ল, যাত্রীরা হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন বাপ রে, ইরাক থেকে পালানো গেছে! আমি দ্বিতীয় বার কারবালা গিয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে। এ বার আমার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। ‘ধন্যবাদ’ জানাতেই যাওয়া। এ বার আমরা তেহরানে নামলাম। সেখান থেকে একটা বাস নিয়ে এলব্রুজ পর্বতমালা পার
হয়ে পৌঁছলাম সীমান্ত-শহর কেরমানশা’য়, তার পর মাথায় লাগেজ নিয়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে ইরাকে। ইরানের দিকে পুরুষ অফিসাররা গোমড়া মুখে পাসপোর্টে ছাপ দিচ্ছেন, ইরাকে স্কার্ট পরিহিত মেয়েরা মাথা ঝুঁকিয়ে বলছেন, ‘হ্যালো’। সেই সহাস্য সাদ্দামের বিরাট কাট-আউট।
|
|
এ বার ‘শত্রু’ পালটে গেছে ইরানের জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বার কারবালায় ইরানির সংখ্যা অনেক বেশি। বুক চাপড়ে আর্তরব: ‘ইয়া হুসেন’। চার পাশে দারিদ্র। ফুটফুটে শিশুরা রাস্তায় ভিক্ষে চাইছে। আরও অনেক স্বামী-হারানো মেয়ে। দেশের মুদ্রার দাম একেবারে তলানিতে। ভারতীয় টাকা পকেটে নিয়ে নিজেকে রাজাবাদশা বলে মনে হচ্ছে। দুনিয়ায় এত সস্তা পেট্রোল কম দেশেই পাওয়া যায়, তাই প্রায় নিখরচায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি। সহযাত্রীদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম গাড়িটা একটু ঘুরিয়ে নিলে ব্যবিলনটা দেখে ফেলা যায়, দশ মিনিট লাগবে ভাই, তার বেশি নয় ওঁরা পাত্তাও দিলেন না। হুসেনের মসোলিয়মের তিনশো মিটার দূরেই অমিতাভ আর শ্রীদেবীর পোস্টার।
ইরাকে পৌঁছনোর চার দিন পরেই পাততাড়ি গোটাতে হল, কারণ সুরাতে প্লেগ ধরা পড়েছে, তাই ভারতের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। কেরমানশা-তেহরান ফ্লাইটে সিট নেই, কাউন্টার বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সাতাশ জন যাত্রী ফিরে গেছেন, তাঁদের নাম ওয়েটিং লিস্টে ছিল। ডিউটি ম্যানেজার এক বার ভারতীয় পুণ্যার্থীদের দেখলেন, তার পর কোথা থেকে কে জানে দুটি আসনের বন্দোবস্ত করে ফেললেন।
পরের দিন তেহরান থেকে দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরলাম। পৌঁছেই এয়ারপোর্টে ফোন করে জানতে চাইলাম, মুম্বইয়ে গাল্ফ এয়ার-এর কোনও বিশেষ ফ্লাইট আছে কি না। একটা চান্স নিয়েছিলাম মাত্র। উত্তর পেলাম, ‘আছে,
দেড় ঘণ্টা পরে।’ আমরা সেই ফ্লাইটটা ধরতে পেরেছিলাম।
তার পর পনেরো দিন দুবাই থেকে ভারতে আর কোনও বিমান আসেনি। |
|
|
|
|
|