|
|
|
|
স্বর্গ যদি কোথাও থাকে |
বাড়ির লোক বেড়াতে গেল বলে কি চেয়ার টেবিল আলমারি পাপোশ, এরা
সব বেড়াতে যায়? কই, তাদের নিয়ে তো কেউ কিছু বলে না! অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
বেড়াতে যাওয়া? দারুণ। ফাটাফাটি। ফ্যান্টাস্টিক। আর বেড়ানোর চেয়েও তেত্রিশ কোটি গুণ দারুণ, ফাটাফাটি, ফ্যান্টাস্টিক হল তার তোড়জোড়, যাকে বলে প্রস্তুতিপর্ব। সেই ছোটবেলায় ভ্রমণকাহিনিতে যেমনটি পড়েছি, ঠিক সেটাই নিজগৃহে ষোড়শোপচারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, অহো! দিন গুনে গুনে ট্রেনের রিজার্ভেশন, হোটেল বুকিং, তার পর কবে কোথায় যাওয়া হবে, তার ডিটেলড প্ল্যানিং, সময়মত ব্যাগ-ট্যাগ নামানো, গরম জামা-টামা কেনা, তার পর আগের দিন সন্ধেবেলায় ‘আরে, টুথব্রাশগুলোই কেনা হয়নি’, ‘ওষুধ নিতে হবে তো’, ‘একটা এভারেডি কমান্ডার কিনে আনতে হবে, শীতকালেও ও সব জায়গায় সাপ বেরোয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি লাস্ট মিনিট ট্রাবল সামলাতে সামলাতে তারিখ পালটে গেল, ‘ওরে শুয়ে পড়, শুয়ে পড়, চারটেয় উঠতে হবে’, ঘুম অবশ্য মোবাইলে অ্যালার্ম বাজার আগেই ভেঙে যাবে, জানা আছে, ঠিক বেড়ানোর উত্তেজনার চেয়ে অ্যালার্মিং আর কিছু আছে নাকি? |
|
তার পর আপাদমস্তক চাপাচুপি দিয়ে ‘ভোরের হাওয়ায় এলে ঘুম ভাঙাতে কীঈঈঈঈঈ’ ভাঁজতে ভাঁজতে স্টেশন অভিযান, তার পর ভোঁ শব্দে প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের আগমন, ‘বা-ই, উইশ ইউ আ হ্যাপি জার্নি, দুগ্গা দুগ্গা...’ তার পর দুলকি চালে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আহা ভোরবেলাটা এমনকী কলকাতাকেও কী মিষ্টি দেখায় ফাঁকা মিনিবাসে চড়ে ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায় বাড়ি ফেরা, সকালের কাগজ এসে গেছে, টেবিলের ওপর অপেক্ষায় আছে, পাঠকের বিলম্ব হচ্ছে বলে একটু অভিমানও হয়েছে বোধহয় আহা, কাগজের বুঝি অভিমান হয় না, আনন্দবাজার বলে কি মানুষ নয়? তার পর রান্নাঘরের দিকে গলাটা বাড়িয়ে ‘ওরে, এক কাপ চা, কুইক’ বলে ছোট্ট বারান্দায় আদুরে চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দেওয়া, হাতে নিউজপ্রিন্ট, পাতায় পাতায় মমতা সূর্যকান্ত কানিমোঝি ব্যাঙ্ক ডাকাতি, চোখের সামনে একটু দূরে পাড়ার ছোট্ট এবং কচুরিপানাময় পুকুরখানা, গায়ে শীতের রোদ্দুর, চায়ের কাপ এল, ধোঁয়া উঠছে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, সে এইখানে, এইখানে...
এ হে হে হে, একটু ঘেঁটে গেল বুঝি? সরি সরি, আমারই ভুল, উত্তেজনার বশে হুড়মুড় করে বলে ফেলেছি। আরে না না, আমি বেড়াতে যাইনি। আমি বেড়াতে যাই না। মানে পারতপক্ষে যাই না। তা হলে যে বললাম, বেড়াতে যাওয়া দারুণ? ফাটাফাটি? ফ্যান্টাস্টিক? তা তো বটেই, অন্যরা যাবে, আমি থাকব।
নাঃ, এমনটা হয় না বিশেষ, ‘যেতে যদি হয়, হবে হবে হবে গো...’ ইত্যাদি বলে বেরিয়েই পড়ি ঠিক, কিন্তু হয় না বলেই কি আর স্বপ্ন দেখতে নেই? হ্যাঁ, ওই যে এতক্ষণ লিখেছি, ওটাই আমার স্বপ্নের বেড়ানো। আমার স্বপ্ন, ওদের বেড়ানো। এমনিতে তো রোজ রোজ অন্যরাও আছে, আমিও আছি। তাকে কি আর থাকা বলে? আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির তত্ত্ব কি তবে বানের জলে ভেসে এসেছে? অন্যরা জঙ্গম, আমি স্থাবর, অন্যরা চলমান, আমি অবিচল, অন্যরা লাট্টু, আমি লাট্টুর নীচে পিনের ডগা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি, ধীর স্থির নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু, তবে না বুঝি, কী সুখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘খুশি রই আপনমনে, বাতাস বহে সুমন্দ’।
না না, রবীন্দ্রনাথকে টেনে এনে সেই অনিঃশেষ বিশ্বপথিকের অপমান করব না, তাঁর মন্ত্র ছিল ‘চরৈবেতি’, আমার ‘তিষ্ঠৈবেতি’। কিন্তু ভেবে দেখুন, পায়ের তলায় এক কিলো সর্ষে নিয়েও তাঁর, তাঁরও মাঝে মাঝে বেশ হোমসিক লাগত, এখানে সেখানে যথা ছিন্নপত্রাবলী দিব্যি লিখে রেখে গেছেন সে কথা, আর আমি হলাম একেবারে আ-আলজিভ ঘরকুনো, আমার অমনি বাড়িতে বসেই মাঝে মাঝে মনটা বাড়ির জন্যে হু হু করে ওঠে। শীতের সকালে, বর্ষার সঘন গহন রাত্রিতে, এমনকী বৈশাখের দ্বিপ্রহরেও। কী করব? এক এক জন এক এক রকম হয়, তাই না? সকলেরই পা চলবে, মন উড়বে, তা কেন? বাড়ির লোক বেড়াতে গেল বলে কি চেয়ার টেবিল আলমারি পাপোশ, এরা সব বেড়াতে যায়? কই, তাদের নিয়ে তো কেউ কিছু বলে না! আর হ্যাঁ, মন উড়বে বলে পা চলতে হবে, তা-ই বা কেন? মন কি সর্ষে, যে পায়ের তলায় থাকবে? এই যে রোজ সকালবেলায় যে যার স্কুল কলেজ অফিস বেরিয়ে যায়, আমি তার পরে অনেক ক্ষণ বাড়িতে থাকি, আমার একটু দেরিতে বেরোলেও চলে, অফিস কিছু বলে না, তাই এ ঘর ও ঘর ঘুরি, কখনও এই জানলায় দাঁড়াই, ওদের বাড়ির ছাদে নীল রঙের শাড়িটা হাওয়ায় দুলছে, কখনও ওই বারান্দায় বসি, সামনের রাস্তা দিয়ে ভাইবোন স্কুলে গেল, কখনও বা বই-ঘরের ডিভানে দিব্যি চিৎপটাং হয়ে পড়ি, গবাক্ষপথে নারকেল গাছের দুটো পাতা একমনে লেফট-রাইট করছে মনে দিব্যি হাওয়া-বাতাস লাগে। বেড়ালে নাকি মনের প্রসার হয়। জীবনে দু’চার বার বেড়াতে গিয়ে দেখেছি মনের কিছুমাত্র প্রসার হয় না, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার বেস্ট স্পটটা দখল করার জন্যে সে কী ঠেলাঠেলি, কত রকমারি প্যাঁচ-পয়জার, বাপ রে! তা ছাড়া, চান তো এক ছত্র জি কে চেস্টারটন শুনিয়ে দিতে পারি, সেই পরম রসিক ইংরেজ বলেছিলেন, ‘They say travel broadens the mind; but you must have the mind.’ কিন্তু সে সব কথা থাক, সব ব্যাপারে এঁড়ে তর্ক করতে নেই, কামস্কাটকায় কিংবা আড়িয়াদহে গিয়ে যার মনের প্রসার হয় তার হয়, আমি খামখা তার মানসিক উত্তরণে বাদ সাধতে যাব কেন? কিন্তু এ কথা হলফ করে বলতে পারি যে, মনের প্রসারের জন্যে এক পা-ও নড়ার দরকার হয় না। নিজের মনে চুপচাপ বসে আকাশপানে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখুন এক বার, মনটা যে কোথায় যাবে আর কোথায় যাবে না, সে আপনি ভাবতেও পারবেন না। অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি সেকন্ডস।
কেন, কীসের টানে এই ঘরে থাকার ব্যারাম? দারাকন্যাপরিবার? পরিচিত বিছানা বালিশ? অভ্যস্ত মাছের ঝোল ভাত? চেনা রাস্তা চেনা মাঠ? জানি না, সত্যিই জানি না। তবে বছর কুড়ি আগে এক বার মাসখানেকের জন্যে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। ভোরবেলায় গাড়ি ছুটল এয়ারপোর্টের পথে। রাস্তার ধারে পাড়ার সিনেমা হল। কী একটা ফালতু বলিউড চলছে, মনেও নেই এখন। কিন্তু, আ ছি ছি, অন্তরাত্মা একেবারে হায় হায় করে উঠল আহা রে, যদি যেতে না হত, এই সিনেমাটা দেখতে পারতাম, আজই। তার পর সেই হল-এ অমন কত ফিল্ম এল, গেল, একটাও দেখা হল না, কিন্তু সে দিনের সেই ট্র্যাজিক যাত্রার ট্র্যাজিকতম মুহূর্ত কোনটি, যদি জানতে চান, দু’বার ভাবব না।
|
|
|
|
|
|