নিজেকে চেনায় পাথর, ঘাস মাইলস্টোন
মাদের খোলসা করে বোঝা বেশ ঝামেলার কি না, বলুন? আহা, আমরা মানে বাঙালিরা। সেই অফ-স্টাম্পের বাইরের চিরন্তন দোলাচল। কিছুতেই বোঝা যায় না, ছাড়ব না মারব। একটা কমফর্ট জোন এঁকে নিয়ে, তাতেই এ দিক ও দিক গুটি চালাচালি করে মহা-খুশ। সে বৃত্তের মধ্যেই হিল্লি-দিল্লি-হনলুলু চলছে। মুখ সয়ে গেলে, অন্য আর এক সেট হিল্লি-দিল্লি মজুত। মানে দৃশ্য বদল হলেও মানসিকতা সেই এক তলায়। ওপরে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না, তো উঠবে কী।
দেখুন, আমি এখানে বাঙালি নিন্দা কমিটি খুলে বসিনি। কিন্তু বাঙালি যখন নিজেকে ভ্রমণপিপাসু, বলতে থাকে, সহ্য হয় না। বেশির ভাগ বাঙালির কাছে বেড়ানো রোজ দিনের একঘেয়েমি কাটানোর মোক্ষম দাওয়াই। অতএব, এক রকম স্ট্রেস-বাস্টার। নতুন পাহাড়, সমুদ্র, লোকাল নকশাওলা হাতের কাজ দেখে মাথার চাপ নিমেষেই হালকা। বেশ কিছু ছবি উঠবে, লাল কালি দিয়ে মার্ক করা ‘সাইট-সিয়িং’ হবে, আর তার পর সেই রেশ ধরে চেনা একঘেয়েমিতে ফেরত, ছুটি শেষে। ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা কিছু কাল ঘুরঘুর করবে পাশবালিশ, ফটো অ্যালবাম আর চায়ের কাপের মাঝখানে। এক দিন ওখানেই মিলেমিশে যাবে সে, পরের ট্র্যাভেল প্ল্যানের তলায়।
বেড়ানো মানে তো একটা জার্নি, আর জার্নি মানেই তো একটা বা একাধিক অভিজ্ঞতা, অনুভব, শিক্ষা, নিজেকে আরও খোলতাই করে চেনার সুযোগ।
আমরা যে ভাবে ঘুরি ফিরি, তাতে এ সব কতটা হয়, খুব সন্দেহ। আপনি বলতে পারেন, আমি চার বার কালিম্পং গিয়েছি, ওখানকার সব গলিগলতা মুখস্থ, তাও আবার এই শীতে যাচ্ছি। কেন? প্রতি বার নতুন কিছু খুঁজে পাই বলেই তো। নিশ্চয়ই। আপনি জায়গাটার সঙ্গে এক রকম ‘সংযোগ’ তৈরি করে ফেলেছেন। ভাল তো। কিন্তু আপনার মন শুধুই একটা রুটেই হাঁটে, বলল কে? বাকি রুট এক্সপ্লোর করবেন না?
এক্সপ্লোর করতে গেলে চেনা নিয়ম ভাঙতে হবে, আবার অপরিচিত নিয়মকেও যেচে কাঁধে তুলে নিতে হবে। মাঝপথে, আর বইব না, বললে কিন্তু ফেল। নিজের কাছেই। যে খুঁজে নেওয়ার কথা আমি বলছি, সেটা কিন্তু ট্রেকিং নয় বা পৃথিবীর কোনও দুরূহ কোণে অ্যাডভেঞ্চারও নয়। হতেই পারে আপনার মামার বাড়ির পাড়ায়। এখানে পায়ের সঙ্গে মনও সমান মাপের খেলোয়াড়। যে মন থাকবে একেবারে নিজের।
সোজা কথা, এক্সপ্লোর করতে গেলে, একা যাওয়াই ভাল। সঙ্গে কেউ থাকলেও, তাঁদের ব্যবস্থা যেন আপনার ঘাড়ে এসে না চাপে। আর একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, রাস্তায় তাজমহল পড়ুক বা কেষ্টপুর খাল, সব কিছুর মধ্যেই একটা অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে। সেটা বাজে লাগতে পারে, কিন্তু তাও জরুরি।
ইয়োরোপ বা আমেরিকা যান, খুব শুনবেন এক্সপেরিমেন্টাল ট্র্যাভেল-এর কথা। এবং বেট ফেলে বলছি, মাথা ঘুরে যাবে। পাগলামিও মনে হতে পারে। কেমন?

এই ধরুন, আপনি প্যারিস পৌঁছলেন। এ বার ম্যাপ বের করে, A দিয়ে শুরু একটা রাস্তার নাম খুঁজে পেলেন। তার পর খোঁজ লাগেলেন Z দিয়ে একটা রাস্তার নাম। পেলেনও। এ বার ওই A থেকে Z পর্যন্ত একটা সোজা লাইন টেনে, বেরিয়ে পড়লেন ব্যাগ পিঠে। রুট-এ যা যা পড়ল, তাই দেখলেন। পাশের গলিতে মণিমুক্তো ভুরভুর করছে জেনেও, মিস দিলেন। এবং কোনও আক্ষেপও পুষে রাখলেন না। একেই বলে অ্যালফাট্যুরিজম।

বা ধরুন, অলটারনেটিং ট্র্যাভেল। এ ক্ষেত্রে আপনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে প্রথমেই ডান দিকে হাঁটা লাগালেন, পরের মোড় আসা মাত্রই বাঁ দিক ঘুরলেন, তার পরের মোড়ে আবার ডান দিক। এমন করে প্রত্যেকটা মোড়ে ডান-বাঁ করতে করতে হাঁটলেন, যত ক্ষণ না সামনে আর কোথাও যাওয়ার নেই। সেখান থেকে চাইলে আবার এই একই ফর্মুলা চালিয়ে যেতে পারেন। এই ভাবে শহরটাকে সত্যিই অন্য চোখে দেখা হয়ে যায়। মনে রাখবেন, শহরের প্রতিটা অংশ কোনও ‘সাইট’ নয়। শহরের গন্ধ, ছন্দ, ভাল-মন্দ বোঝার এর থেকে বেটার উপায় আছে কি?

কন্ট্রেট্যুরিজম-এর কথা শুনলে প্রথমে খানিক হাসিই পাবে, বলবেন বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, এরও একটা মানে আছে। আমরা কী করি, কোনও মনুমেন্ট-এর সামনে গিয়ে, সেটির দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি তো, কন্ট্রেট্যুরিজম বলে উল্টো দিকে চাও। মানে, মনুমেন্ট-এর দিকে পিছন করে, যে দিক থেকে হেঁটে এলাম, সেই ভিউটা উপভোগ করলাম। আপনি বলবেন, ভিউ? কীসের ভিউ? সামনে আইফেল টাওয়ার আর আমি পিছন ফিরে ফুটপাথ আর বাচ্চা বেড়াল দেখব? ইয়ার্কি! না। জাস্ট অন্য একটা দৃষ্টিকোণ দিয়ে আবহাওয়াটাকে অনুভব করা। বুঝে ফেলা, যা ঝকমকে নয়, যা চোখ টানে না, তার মধ্যেও একটা অদৃশ্য গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে। পড়ে নেওয়া আপনার কম্ম।

যে শহরেই যান, সেটিকে ভাল বন্ধুর মতো দেখুন। খেয়াল রাখুন, আপনার নিরন্তর ঘোরাঘুরির ফলে শহরটার কোনও ক্ষতি না হয়। টিলার ওপর উঠে মন্দির দেখলেন, ভাল, কিন্তু শুধু পুজো দিলেই তাকে সম্মান জানানো হয় না। চিপ্স-এর প্যাকেটটা না ফেলে আসাটা বরং বেশি কাজের। আর আপনি যদি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিপ্স না খেয়ে সেই অঞ্চলের লোকাল চিপ খান, তা হলে তো কথাই নেই। মানে আপনি যে অঞ্চলে রইলেন, তাকেই কিছু ফেরত দিয়ে এলেন। যতটা পারলেন, ওঁদের হোটেলে থাকলেন, ওঁদের খাবার খেলেন। বলতে গেলে, ওই অঞ্চলের সঙ্গে একটা সুতো জুড়লেন নিজের। একে বলে এথিকাল ট্যুরিজম।
এমন আরও এক্সপেরিমেন্টাল ট্র্যাভেল আইডিয়া শুনিয়ে যেতে পারি, কিন্তু যদি আসল স্পিরিটটাই না ধরা যায়? সারা ক্ষণ পার অ্যানাম কত, আর ফুলকপি একটাই ২৫! ভাবলে, ও স্পিরিট-এর দেখা আপনি পাবেন না। না, সন্ন্যাস নেওয়ার কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, সুইচ অন সুইচ অফ-এর। মনকে সব রকম অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভ্যাস করান । ফুলকপিতেও আছি, ভীল সম্প্রদায়ের সঙ্গে পিঁপড়ের চাটনি খাওয়াতেও। অনুভব করতে হবে সেই সব, যা অ্যাদ্দিন ধরে খরখরে, চিটচিটে, স্যাঁতসেঁতে ভেবেছি। তবে সেটা হতে হবে তাদের মতো করে, নাক শিঁটকে নয়। নিজেকে বার বার পরীক্ষার সামনে ফেলুন। যে দেখি তো এই অবস্থায় আমি কী করি?
এক্সপেরিমেন্টাল ট্র্যাভেল আপনাকে এমন অনেক প্রশ্নের সঙ্গে আলাপ করাবে। সেই আলাপ অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় যাবে কি না, তা আপনার হাতে। পায়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.