‘টাঙ্গা লাও টাঙ্গানাইকা যানা হ্যায়’
ধু ধু মরুভূমির মধ্যে চৈতন্য হারানো মন্দার বোসকে খুঁজে পায় এক উটওয়ালা। ভোরবেলা উটের দুধের চা খাইয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলার পর একটু ধাতস্থ হয়েই তিনি বার বার নিজের টাক থাবড়াতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, ‘কপাল, কপাল’। তার পরে ‘মিশটেক, মিশটেক’। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করায় ভয়ানক রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘টাঙ্গা লাও, টাঙ্গানাইকা যানা হ্যায়।’
গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির-এর সঙ্গে বুদ্ধির দৌড়ে পাল্লা দিতে গিয়ে হেরে যাওয়া মন্দার বোস-এর আসল নাম কিন্তু মধুসূদন দাস। নানা কারণে বার বার নিজের নাম বদল করতে হয়েছে জীবনে, তার সঙ্গে ছদ্মবেশ। অবশ্য এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। উত্তর কলকাতার গড়পারে আড্ডা মারতে মারতেই ছোটবেলাটা পেরিয়ে যায়, স্কুলটা আর পেরোনো হয়নি। দুর্ভাগ্য মধুসূদনের, মাস্টারমশাইরা নম্বরগুলো নিজের বাড়ি নিয়ে যেতেন। ছোট থেকেই যাঁর জীবনের জিয়োমেট্রিটা ভয়ানক জটিল, পরীক্ষায় তাঁর অঙ্কের উত্তর না মেলাটাই স্বাভাবিক। ভাল লাগত জিয়োগ্রাফি। ভূগোল বইয়ের ম্যাপের পাতায় চোখ স্থির হয়ে থাকত তাঁর। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়া ছিল। কল্পনায় বার বার ফিরে আসত আফ্রিকা। দুঃখের ব্যাপার, স্কুল-কলেজে ‘গ্লোব ট্রটিং’ বলে কোনও বিষয় পড়ানো হয় না। তাই ভূ-পর্যটক হওয়ার পেশাটা অধরাই থেকে গিয়েছিল। শুধু নাইরোবি, মোম্বাসা, সাভো, মাসাইমারা শব্দগুলো ঘুরপাক খেত মনে। কলকাতার ভিক্টোরিয়ার জলের ধারে বসে লেক ভিক্টোরিয়াটা কত বড়, অথবা গরুমারা আর মাসাইমারার তফাতটা ঠিক কী, সেটা চিরকালই ধোঁয়াটে রয়ে গিয়েছিল। দেশের সীমাটা আর পেরোনো হয়ে ওঠেনি। ঠিক এই অবস্থায় দেখা হয়ে যায় স্বামী ভবানন্দের সঙ্গে, এলাহাবাদে, নাইন্টিন সিক্সটি টু’তে।
বাস্তবের বদলে কল্পনা, সত্যির বদলে মিথ্যেকে মূলধন করে যে ব্যবসা করা যায়, সেই বিদ্যার হাতে খড়ি হয় ওই সময়ে। নিজের নাম, চেহারা বদল করে ম্যাজিকের মতো মোটা টাকা রোজগার করা যে সম্ভব, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। তত দিনে বদলে গিয়েছে নাম। নতুন পরিচয় মন্দার বোস। দুঃখের ব্যাপার ভবানন্দ ধরা পড়ে যায়। অদৃশ্য হয়ে যান মন্দার বোস। জানা ছিল নেতাজির আফগানিস্তান পেরিয়ে রাশিয়া পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। সেই থেকেই বেলুচিস্তান টপকে যাওয়ার আইডিয়াটা মাথায় আসে। হয়ে ওঠেনি। কারণ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চলায় সীমান্তের অবস্থা গোলমেলে হয়ে পড়েছিল।
মাসাইমারা
ছদ্মনাম, ছদ্মবেশের পারদর্শিতাই শেষ পর্যন্ত মন্দার বোসকে পার করে দেয় দেশের সীমানা। আরবগামী কুলি-মজুরদের সঙ্গে কোচিন থেকে জাহাজের খোলে ঢুকে মন্দার বোস পৌঁছে যান পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে। তার পর বেদুইনদের পাল্লায় পড়ে সাহারার ধার ঘেঁষে ইউরোপ। চোরাই জিনিসপত্র পাচারের কাজ থেকে সদ্য অবসর নেওয়া এক ইটালিয়ান মাফিয়ার কল্যাণে নেপল্স বন্দরে পৌঁছতে অসুবিধে হয়নি। এর কিছু দিনের মধ্যেই সুইজারল্যান্ড-এর জেনিভা। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট ভরা রাস্তায় খেলা দেখানো এক জাগলার-এর সঙ্গে আলাপ এবং হরেক রকমের ম্যাজিক শেখার এটাই শুরু। দেশে ফিরে জাগলিং দেখিয়ে ভদ্রস্থ রোজগারের সম্ভাবনা নেই, সেটা জানতেন মন্দার বোস। তাই নকল সুইস ঘড়ি তৈরি করে কলকাতার রাধাবাজারে বিক্রি করার প্ল্যানটা মাথায় আসে। কপাল খারাপ, পড়তায় পোষায়নি। তত দিনে দিব্যি ভাল দিশি ঘড়ি ছেয়ে গিয়েছে বাজারে।
ব্রেজিল-এ শুধু জঙ্গলের মধ্যে ভয়ঙ্কর জন্তু-জানোয়ার থাকে, রাস্তায় নরমুণ্ড শিকারিরা থিকথিক করছে এমন যে নয়, সেটা জানতেন মন্দার বোস, ওই জিয়োগ্রাফির কল্যাণে। হাজার হাজার স্কোয়্যার মাইল ফাঁকা জায়গায় আখের চাষ করা যেতে পারে। আখ থেকে আখের শরবত, তা থেকে আরও কত কী সব প্ল্যানই নিখুঁত ছিল। কিন্তু কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। আখের পরিবর্তে দাঁত, হাতির দাঁতের ব্যবসার দোরগোড়ায় পৌঁছেও ফিরে আসেন কেনিয়া থেকে। সে গুড়ে বালি হওয়ার কারণ সারা দুনিয়ায় তত দিনে শিকারটিকার নিষিদ্ধ হয়ে ভয়ানক কড়াকড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে, একা আর কী-ই বা করবেন।
আবার যে ভবানন্দ-এর সঙ্গে দেখা হবে, রাজস্থানের কেল্লায় ধনরত্নের গল্প বলা খোকা আর তার প্যারাসাইকলজিস্ট গার্জেন ডাক্তার হাজরাকে তাড়া করে থর মরুভূমি অবধি ছুটে আসতে হবে, সেটাও কপালেরই লিখন। নকল ডাক্তার হাজরার স্যাঙাত হিসেবে আসল ডাক্তার হাজরাকে খুন করতে হবে, এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। বাধ সাধল উড়ে এসে জুড়ে বসা ডিটেকটিভ ফেলু মিত্তির, তাঁর স্যাটেলাইট তোপসে আর জং ধরা ভোজালিওয়ালা গোয়েন্দা গপ্পো রাইটার জটায়ু।
নিজের জীবন বিপন্ন করে বিষাক্ত বিছে ধরা, রাস্তায় বোতলের কাচ ভেঙে পরের যাত্রা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কী না করেছেন নিজের শেয়ারটুকুর লোভে। কিছুই হয়নি, মাঝ রাতে কনকনে ঠান্ডা মরুভূমিতে পড়ে থাকতে হয়েছে অসহ্য গাঁটের যন্ত্রণা নিয়ে।
নেপল্স বন্দর
আফ্রিকা ছোঁয়া দর্জি পাড়ার বাঙালি মন্দার বোস। ভাগ্যের অভাব থাকলেও পৌরুষের খামতি পড়েনি। কপাল থেকে ঘাড় পর্যন্ত অভিজ্ঞ পরিষ্কার মাথায় রিভেঞ্জ-এর ব্যাপারটা ঘোরাফেরা করতে শুরু করে এর পরেই। কলকাতায় ফিরে সিধে পথে রোজগারের চেষ্টা করেননি, তা-ও নয়। হারুন-অল-রশিদ ছদ্মনামে ধর্মতলায় জাগলিং দেখিয়েছেন, সঙ্গে ছিল ফটিকচাঁদ। পরে জানা গেল, সে ভদ্র বাড়ির ছেলে মন ঘুরে গেল মন্দার বোস-এর। ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন বেনারসে। চাকরি পেলেন নাইফ ব্লোয়ারের, মগনলাল মেঘরাজ-এর প্রাইভেট সার্কাসে। ভালই চলছিল, কাজের চাপ তো তেমন নেই। ষাঁড়, সাইকেল রিকশা বাঁচিয়ে রাবড়ি-কচুরি খেয়ে খেয়ে মনটা নরম হয়ে আসছিল। বয়েসটাও তো কম হল না।
ভাগ্যের এমনই খেলা, ওখানেই ফের উদয় হল ফেলু মিত্তিরের দল। জটায়ুর বদলে সেয়ানা গোয়েন্দার দিকে ছুরিটা ছুঁড়লেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি, কারণ ঘুলঘুলির ভেতর থেকে তাক করা পিস্তলটা তা হলে ঘুরে যেত অন্য দিকে। মগনলালের খেল অচিরেই শেষ হয়। এক দিনের জেল আর সাত দিনের ফাঁসি হওয়ায় মন্দার বোস রাতের অন্ধকারে কলকাতার ট্রেন ধরেন মোগলসরাই থেকে।
এর অনেক বছর পরে একটা আশ্চর্য খবর কানে আসে মন্দার বোস-এর। তত দিনে অবশ্য তিনি ‘কাজ’ থেকে অবসর নিয়েছেন। খবরটা হল ফেলু মিত্তির এন্ড কোম্পানি নাকি নিজেরাই ভোল বদলে ফেলেছে। রজনী সেন রোড নয়, বিশপ লেফ্রয় রোডে নাকি থাকেন ওঁদের আসল লোক। তাঁর নাম মিষ্টার রায়। তিনি বায়োস্কোপও করেন। পাশের গলিতে সেদ্ধ তিব্বতি শিঙারা খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেল, মিষ্টার রায়ের বাড়ির গেট অবধি পৌঁছে, বার বার ঘোরাঘুরি করেও কোনও লাভ হল না। কারণ তিনিও নাকি ভ্যানিশ হয়ে গেছেন।
শেষ পর্যন্ত শীতকালের এক সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনের স্টেজে, আলো অন্ধকারের মধ্যে আসল ফেলু মিত্তিরকে খুঁজে পান মন্দার বোস। আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি তখন কবিতা আবৃত্তি করছেন। সেই দেখে সিটে বসেই অজ্ঞান হয়ে যান উত্তর কলকাতার দুঃসাহসিক গ্লোব ট্রটার।
এর পর তাঁর কী হল, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারেননি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.