কর্তারা যেতেই ওয়ার্ড ফিরল সেই তিমিরে |
‘তদন্ত’ চলছে।
ওয়ার্ড ঘুরে দেখে স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, শিশুমৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’ নয়। বরং দিব্যি চিকিৎসা চলছে।
চিকিৎসক-নার্সদের গরহাজিরার অভিযোগও মানতে রাজি নন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে।
কে না জানে, পুজো থেকে কালীপুজো মানেই ‘ছুটির মেজাজ’। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালও তার ব্যতিক্রম নয়। রোগীদের আক্ষেপ, পুজোর সময়ে অর্ধেক চিকিৎসক ছুটি নেন। তাঁরা ফিরতেই বাকিরা কালীপুজোর সময়ে ছুটিতে চলে যান। সামান্য চিকিৎসাটুকু পেতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়।
বর্ধমান মেডিক্যালের সুপার গদাধর মিত্র থেকে ডেপুটি সুপার তাপস ঘোষ অবশ্য চিকিৎসক ও নার্সদের একযোগে ছুটিতে যাওয়ার অভিযোগ মানতে রাজি নন। কিন্তু কত চিকিৎসক ও নার্স থাকার কথা, বুধবার থেকে কত জন উপস্থিত ছিলেন, তার পরিসংখ্যানও তাঁরা দিতে চাননি। শুক্রবার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে কিন্তু অনেক চিকিৎসকেরই দেখা মেলেনি। নার্সদেরও গয়ংগচ্ছ ভাব। তবে শিশু বিভাগে তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১২টি শিশুর মৃত্যুর জেরে কলকাতা থেকে স্বাস্থ্যকর্তারা আসছেন, সে খবর দুপুর থেকেই ছিল। খবর পাওয়া মাত্র শুরু হয়ে যায় সাফাইয়ের কাজ। যেখানে আলো ছিল না, সেখানে তড়িঘড়ি লাগিয়ে ফেলা হয় আলো। ভর্তি থাকা শিশুদের বাড়ির লোকজনের দাবি, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কার্যত শূন্য পড়ে থাকা শিশু ওয়ার্ডে হঠাৎই ছুটে আসেন কয়েক জন চিকিৎক ও নার্স। মলমূত্রে নোংরা হয়ে পড়ে থাকা ওয়ার্ড পরিষ্কার করে ব্লিচিং ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জোরকদমে শুরু হয়ে যায় শিশুদের যত্ন-আত্তিও। |
মেঝেতেই ঠাঁই। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে তোলা নিজস্ব চিত্র। |
কলকাতা থেকে এসে প্রথমে সুপার, ডেপুটি সুপার, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলাশাসকের সঙ্গে আধঘণ্টা বৈঠক করেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাস্থ্য কমিশনার দিলীপ ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ যান সদ্য সাফসুতরো হওয়া ওয়ার্ডে। অসুস্থ শিশুদের আত্মীয়দের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেন। তার পরেই তাঁরা জানান, এই শিশুমৃত্যুর মধ্যে কোনও ‘অস্বাভাবিকতা’ নেই। গোটাটাই সংবাদমাধ্যমের ‘অপপ্রচার’। ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে দুই স্বাস্থ্যকর্তা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, কিছু অসুস্থ শিশুর আত্মীয়স্বজন তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু হাসপাতালের কিছু কর্মী তাঁদের বাধা দেন। বলেন, “যা বলার, সুপারের অফিসে গিয়ে বলুন। স্যারদের বিরক্ত করবেন না।”
দুই কর্তা ফিরতেই শিশু বিভাগও তার আগের চেহারায় ফিরে যায়। খানিক পরেই সেখানে গিয়ে কোনও চিকিৎসক বা নার্সের দেখা মেলেনি। শিশুদের ‘বডি ওয়ার্মার’ বিভাগে গিয়েও দেখা যায়, শরীর গরম করার যন্ত্রে শোয়ানো রয়েছে অন্তত পাঁচটি শিশু। কিন্তু কোনও চিকিৎসক বা নার্স হাজির নেই। এ দিনই শ্বাসকষ্টে ভোগা সদ্যোজাতকে নিয়ে ওই বিভাগে ভর্তি হয়েছেন বাঁকুড়ার পাত্রসায়র থেকে আসা পুষ্পরানি বাস্কে। তাঁর অভিযোগ, “এক বারই মাত্র এক জন ডাক্তার এসে আমার মেয়েকে দেখে যান। তার পরে সারা দিনে আর কেউ আসেননি। কোনও ওষুধও পাইনি।” জ্বরাক্রান্ত পাঁচ বছরের নাতনি পূর্ণিমাকে নিয়ে তিন দিন ধরে ওই ওয়ার্ডে রয়েছেন পূর্বস্থলীর নতুনহাটের অলকা দাস। তাঁর আক্ষেপ, “তিন দিনেও বড় ডাক্তারের দেখা পাইনি। নাতনি জ্বরের চোটে কিছু খেতে পারছে না। কিন্তু ওয়ার্ড থেকে বলা হচ্ছে, এই অবস্থাতেই ওকে ওষুধ খাইয়ে যেতে।”
মেমারির দেবীপুরের বাসিন্দা দেবব্রত মল্লিকের খেদ, “আমার সদ্যোজাত ছেলে টানা ১২দিন ধরে এখানে ভর্তি। প্রচণ্ড পায়খানা আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সারা দিনে এক বার মাত্র দেখে ওষুধ লিখে দিয়ে যাচ্ছেন হাউসস্টাফেরা। বড় ডাক্তারদের তো দেখতেই পাইনি।” সাত দিন ধরে সদ্যোজাত নিয়ে ভর্তি আছেন কেতুগ্রামের তনুশ্রী মাঝিও। শিশুটির খিঁচুনি হচ্ছে থেকে থেকে। আতঙ্কিত গলায় তনুশ্রী বলেন, “চোখের সামনে পরপর শিশুদের মারা যেতে দেখছি। কয়েক দিন ধরেই ডাক্তার বা নার্সদের দেখা পাচ্ছি না। আমার বাচ্চার কী হবে?” টানা ১২ দিন ধরে জন্ডিস আক্রান্ত শিশুকে ‘বডি ওয়ার্মার’ ওয়ার্ডে রয়েছেন বীরভূমের মুরারই থানার ফতেপুরের বাসিন্দা আবুল আসপিয়া। তাঁরও অভিযোগ, “কালীপুজোর দিন থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত এক জন ডাক্তারকেও দেখতে পাইনি।”
এই সমস্ত অভিযোগের জবাবে কর্তৃপক্ষের তরফে অবশ্য একটিই উত্তর মিলেছে, ‘তদন্ত চলছে।’ তার বেশি কিছু সুপার বা ডেপুটি সুপার বলতে চাননি। বর্ধমানের জেলাশাসক তথা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য ওঙ্কার সিংহ মিনা আবার পরিকাঠামোগত দুর্বলতার দিকেই আঙুল তুলেছেন। তিনি বলেন, “স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিকাঠামোয় যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। সমস্যা মেটাতে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ৮৭ লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছিল। সম্প্রসারণের কাজও প্রায় শেষের মুখে। নতুন একটি ভবনে অন্তর্বিভাগ সরিয়ে নেওয়া হবে। তখন ১৯০ থেকে ২০০টি শিশুকে সেখানে ভর্তি করানো যাবে।”
যারা মারা গেল, তাদের কি আর ফেরানো যাবে? |