বিপর্যয়ের পরে সিপিএমকে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বাম ঐক্য নিয়ে। বামফ্রন্টের ভিতরে এবং বাইরে। শরিকদের মুখোমুখি বসে এক দিকে যেমন ফ্রন্টের ভিতরের আবহাওয়া পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে, তেমনই ফ্রন্টের বাইরেও বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার ভাবনাকে ‘গুরুত্ব’ দিতে হচ্ছে।
সঙ্কটকালে আলিমুদ্দিনের এই প্রয়াস কতটা ‘ফলপ্রসূ’ হবে, তা নিয়ে অবশ্য সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, বাম শরিকেরাই সিপিএমের মনোভাব নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধায়। সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে মুখোমুখি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরে শরিক নেতাদের বড় অংশেরই প্রশ্ন, এমন নজিরবিহীন নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে ‘ভুল’ স্বীকারে আলিমুদ্দিন সত্যিই কতটা ‘আন্তরিক’? পরাজয়ের পরে সব সভা-সমাবেশেই সিপিএম নেতৃত্ব নিয়ম করে ‘ত্রুটি সংশোধনে’র কথা বলছেন। কিন্তু শরিক নেতৃত্বের মতে, শুধু কথার কথা হিসাবে ‘ভুল’ স্বীকার না-করে যেখানে যেখানে সত্যিই গলদ হয়েছিল, সেগুলি খোলাখুলি কবুল করতে সিপিএমের এখনও দ্বিধা রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় শরিক নেতারা তাঁদের মতো করে বিপর্যয়ের কারণ খোলামেলা বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু তাঁদের মনোভাব খোলসা করতে চাননি। শরিকদের মতে সরাসরি সায় দেননি। আবার খারিজও করেননি! এর থেকেই শরিক নেতাদের অভিমত, ভিতরে ভিতরে সিপিএম এখনও প্রকৃতই ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রস্তুত নয়।
সিপিএম অবশ্য মনে করছে, নজিরবিহীন ‘আক্রমণে’র মুখে বাম শরিকদের পাশে নিয়ে চলাই এই মুহূর্তে জরুরি। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাতে অনেক জায়গায় প্রার্থী দেওয়াই হয়তো সম্ভব হবে না বামেদের পক্ষে। তা ছাড়া, পঞ্চায়েতের মতো নিচু তলার ভোটে বাম ঐক্যের বিষয়টি রাজ্য নেতৃত্বের হাতে থাকেও না। তা সত্ত্বেও আলিমুদ্দিন চাইছে, রাজ্য স্তরে বিরোধী ভূমিকা পালন করার সময় এবং পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্য স্তরে যেন ‘ভুল বোঝাবুঝি’ না-থাকে। সেই জন্যই ডিএসপি, মাক্সর্বাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, ওয়াকার্স পার্টির মতো ছোট শরিকদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সিপিএম নেতৃত্ব আশ্বাস দিয়েছেন, ‘কঠিন’ সময়ে দল চালাতে সমস্যা হলে তাঁদের নির্দ্বিধায় বলতে। ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআইয়ের মতো তুলনায় বড় শরিকদের সঙ্গে আলোচনায় হাজির থেকেছেন খোদ বুদ্ধবাবু। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “শরিক নেতারা তাঁর বিগত সরকারের নীতির সমালোচনা করবেন জেনেও বুদ্ধবাবু ছিলেন। কারণ, এখন সকলে মিলেই আক্রমণ প্রতিহত করে এগোনোর সময়।”
আরএসপি, সিপিআই এবং ফ ব বেশ কিছু দিন ধরেই বামফ্রন্টের বাইরে ‘বৃহত্তর’ বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরব। এ বারের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা-পর্বে সে কথা তারা বুদ্ধবাবু-বিমানবাবুদেরও বলেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ফ্রন্টের বাইরে যারা ‘লেফ্ট আউট’, তাদের সঙ্গে পেলে ভালই হয়। কী ভাবে এগোলে সেটা সম্ভব হতে পারে, দেখতে হবে।” অর্থাৎ ‘বৃহত্তর’ বাম ঐক্য এখন সিপিএমের বিবেচনাতেও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা হল, ফ্রন্টের বাইরে যে সব শক্তি দীর্ঘ দিন বাম আন্দোলন করছে, তাদের বড় অংশই সিপিএমকে নিয়ে কোনও বৃহত্তর বাম মঞ্চের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে সংশয়ী।
সিপিএমের পক্ষে আরও সমস্যার কথা, ফ্রন্টের অন্দরেও শরিকেরা তাদের নিয়ে এখনও যথেষ্ট সন্দিহান। সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “মনে হচ্ছে, ওঁরা মচকালেও ভাঙবেন না! বিপর্যয়ের কারণগুলি ওঁরা শুধু ওঁদের মতো করেই ভাবছেন। আবার এ-ও হতে পারে, পুরোটা ভেবে উঠতেই পারেননি! সেটা হয়ে থাকলে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসের আগে আর দিশা মেলার সম্ভাবনা কম।” বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দলীয় সমীক্ষা রিপোর্ট আলিমুদ্দিনকে দিয়েছেন সিপিআই নেতৃত্ব। কিন্তু সিপিএমের রিপোর্ট পাননি।
আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “উন্নয়নের যে মডেল নিতে গিয়ে আমাদের ভরাডুবি হল, ফ্রন্টের মধ্যে যে দাদাগিরি চালাতে গিয়ে ওঁরা সমস্যা তৈরি করলেন, সেগুলি নিয়ে কোনও সংশোধনের লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু, যে সব প্রশ্নে আন্দোলনের কর্মসূচি নিচ্ছেন, তাতে প্রশ্ন উঠছে, ৩৪ বছর আপনারা কী করছিলেন? এখন নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে সিপিএমকে।” ফ ব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সিপিএম এখনও তৈরি নয় বলেই মনে হচ্ছে।” এই পরিস্থিতিতে বাম ঐক্যের স্বার্থে এবং জন-দরবারে ‘গ্রহণযোগ্য’ কর্মসূচি হিসাবে নিউ টাউনের ‘জ্যোতি বসু নগর’ নামকরণ বাতিলের প্রতিবাদে রাজ্যপালের কাছে বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে প্রাক্তন বাম মন্ত্রিসভার কোর কমিটিকে দরবার করতে পাঠানোর প্রস্তাব ফ্রন্টে বিবেচনায় রয়েছে। নানা ‘সংশয়ে’র বাতাবরণে প্রয়াত বসুই এখনও সংশয়হীন সেতু! |