ফোঁটা দিয়ে আক্ষেপ ঘুচল কুষ্ঠ কলোনির ‘দিদিদের’
পার হয়ে গিয়েছে কত ভাইফোঁটার দিন। কিন্তু ভাইদের কপালে ফোঁটা দেওয়া হয়নি। কুষ্ঠ কলোনির ছোট্ট বাড়িতে বসে ভাই-দাদাদের কথা মনে করে চোখের জল ফেলাই সার হয়েছে। দাদা-ভাইরা ফিরেও তাকায়নি তাঁদের কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত দিদি-বোনেদের দিকে। কলোনির পুরুষদেরও একই দুঃখ। বাড়ি থেকে দিদি বা বোন ফোঁটা দিতে আসেনি।
তবে, শুক্রবার তাঁদের সেই দুঃখ অনেকটাই কেটে গেল। বাঁকুড়ার মঙ্গলচণ্ডী ও কল্যাণপুর কুষ্ঠ কলোনির মহিলারা কলোনির দাদা-ভাইদের ফোঁটা দিলেন। কিছুটা হলেও তাঁদের মনের আক্ষেপ দূর হল। বিষ্ণুপুর মহকুমা সংশোধনাগারের বন্দিদেরও এ দিন ফোঁটা দেওয়া হয়।
বিষ্ণুপুর সংশোধনাগারে ফোঁটা। ছবি: শুভ্র মিত্র।
এ দিন সকাল সকাল স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরেছিলেন ওঁরা। থালায় প্রদীপ, ধান, দূর্বা ও মিষ্টি সাজিয়ে দাদা-ভাইদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কুষ্ঠ কলোনির বাসিন্দা লতিকা সিং, লক্ষ্মী ধর, মালা মাহাতো, রেখা বেরা-সহ অনেকে। তাঁদের কুষ্ঠ কলোনির দাদা-ভাইরাও তত ক্ষণে স্নান সেরে পরিস্কার পোশাক পরে জড়ো হচ্ছিলেন। মঙ্গলচণ্ডী কলোনির ফাঁকা মাঠে ভাইফোঁটা দেওয়ার আসর বসেছিল। দাদা-ভাইরা পাশাপাশি বসলেন। তাঁদের কপালে ফোঁটা দিলেন দিদি-বোনেরা।
লক্ষ্মী ধর বলেন, “দুর্গাপুরে আমার বাড়ি। সেখানে তিন ভাই রয়েছে। ১৪ বছর আগে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হই। চিকিৎসা করানোর জন্য এখানে ভর্তি করে দিয়ে যায় বাড়ির লোকজন। তারপর থেকে ভাইরা আর খবর নিতে আসেনি। ফোঁটা নিতেও আসেনি।” এখনও তাঁর স্মৃতিতে তাজা, “বাড়িতে ভাইফোঁটার দিন কত আনন্দ হত। ফোঁটা দেওয়া পরে ওরা আমাকে চকলেট দিত, টাকা দিত। টাকা জমিয়ে শখের জিনিস কিনতাম। সারা বছর ধরে ভাইফোঁটার দিনটা জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম।” আক্ষেপ ঝরা গলায় জানান, ‘ভাইরা সুস্থ থাকুক’ এই প্রার্থনা তিনি আজও করেন। কলোনির আর এক বাসিন্দা অন্নমিতা রায় জানান, সিমলাপালে তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়িতেও তিন জন দাদা রয়েছেন। তিনি সবার ছোট। প্রায় দেড় দশক ধরে বাড়ির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। ফোঁটা না দেওয়ার দুঃখ আজও তাঁর মনে রয়েছে। তাঁরা জানান, কয়েক বছর ধরে তাঁরাই ভাইফোঁটার আয়োজন করে আসছেন। এতে কলোনির পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ভাইফোঁটা নিয়ে এত দিন যে দুঃখ ছিল, তা অনেকটাই কেটেছে।
কুষ্ঠ কলোনিতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ফোঁটা নেওয়া পরে সুনীল পাল, রাজেন রায়রা বলেন, “ছেলেবেলা থেকে যাদের আপন ভেবে এসেছি, কুষ্ঠ আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁরাই আমাদের পর করে দিয়েছে। যাঁদের চিনতাম না, সেই কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত বোনেরা আমাদের পরম যত্নে ফোঁটা দিলেন। এ তো কম বড় পাওনা নয়!”
এ দিন কোলাঘাটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক মহিলা সদস্য এসে কলোনির পুরুষদের ফোঁটা দেন। পুরুষ সদস্যদের ফোঁটা দেন কলোনির মহিলারা। সংগঠনের সম্পাদক কৃষ্ণেুন্দু বেরা বলেন, “ওঁদের সঙ্গে এক সাথে ভাইফোঁটায় অংশ নিয়ে আমরাও খুশি। সবাই মিলে যেন এক পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলাম।
অন্যদিকে, শুক্রবার বিষ্ণুপুর মহকুমা সংশোধনাগারের বন্দিদের ভাইফোঁটা দেওয়া হল। মল্লভূম যোগব্যায়াম কেন্দ্রের মহিলা সদস্যেরা তাঁদের ফোঁটা দেন। ওই সংশোধনাগারের দায়িত্বে থাকা সুপার তথা বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক সুশান্ত চক্রবর্তী বলেন, “ওদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”
এ দিন সংশোধনাগারের ভিতরে ফাঁকা জায়গায় গোল হয়ে বসেছিলেন ৭২ জন পুরুষ আসামি। তাঁদের কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টিমুখ করালেন ওই যোগকেন্দ্রের সদস্যেরা। সংশোধনাগারের বন্দিদের ফোঁটা দেওয়ার পরে বন্দনা দাস, রেশমি দত্ত, অপর্ণা চন্দ, স্বাগতা দাসেরা খুশি। মিষ্টিমুখ করানো হয় সংশোধনাগারের ১১ জন মহিলা বন্দিকেও।
বন্দিদের মধ্যে ফটিক গায়েন, শেখ আজিজুর গান শোনান। এক বন্দি অরুন সরকার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, “জেল এখন সত্যিই সংশোধনাগার। এখানকার পরিবেশ অনেক ভাল। নানা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে। চরিত্র সংশোধনের সুযোগ বেড়েছে।” তিনি জানান, এক সঙ্গে এত বোনের ফোঁটা নেওয়ার পরে তাঁদের মন খুশিতে ভরে গিয়েছে।
সংশোধনাগারের জেলার নরেন্দ্রনাথ বসু রায়চৌধুরী বলেন, “উত্তরবঙ্গে থাকাকালীন সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলাম। এ দিনের অনুষ্ঠানে সবাই খুব খুশি হয়েছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.