ইরানের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে অন্য মাত্রা আনতে আসরে এ বার দুই বাঙালি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জগদীশচন্দ্র বসু!
আগামী সপ্তাহে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল নিয়ে তেহরান যাচ্ছেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার। তাঁর উপস্থিতিতে ইরান পার্লামেন্টের সংগ্রহশালায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা-খচিত একটি ফলক লাগানো হবে। সেখানকার ‘টেকনোলজি পার্ক’-এ জগদীশচন্দ্র বসুর একটি মূর্তিরও উদ্বোধন করবেন মীরা।
প্রায় আশি বছর আগে ইরানের রাজা রেজা শাহের আমন্ত্রণে সে দেশে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি অমিয় চক্রবর্তী এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে ইস্পাহান, সিরাজ এবং তেহরান সফর করেছিলেন তিনি। সেখানে কাটিয়েছিলেন ৭১তম জন্মদিনটি এবং ইরানবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন একটি কবিতা। তার প্রথম ক’টি ছত্র এই রকম
‘ইরান তোমার যত বুলবুল
তোমার কাননে বসন্ত ফুল
বিদেশি কবির জন্মদিনেরে মানি
শুনালো তাহারে অভিনন্দনবাণী...।’
এই কবিতাটিই পার্লামেন্টে উৎকীর্ণ করে রাখতে চলেছে ইরান সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্ধশতবর্ষের এই বছরটিতে ভারতীয় জীবন ও কৃষ্টির বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি কূটনীতিতেও ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষত এশিয়ার বিক্ষুব্ধ প্রেক্ষাপটে তাঁকে নতুন করে খুঁজতে তৎপর বাংলাদেশ থেকে চিন অনেক দেশই। সেই তালিকায় এ বার নবতম সংযোজন ইরান। |
১৯৩২ সালে তেহরানের ‘মজলিসে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিজস্ব চিত্র |
ভারতে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস সূত্র বলছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাদের উৎসাহ মোটেই নতুন নয়। ১৯৩২ সালেই ইরানের মাটিতে দর্শন ও সাহিত্যের এক নতুন বীজ বপন করে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই স্মৃতিকে কিছুটা উস্কে দিয়েই বিশ্ব কূটনীতিতে কিছুটা কোণঠাসা তেহরান এখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
ইরানের ব্যাপারে একই রকম উৎসাহী নয়াদিল্লিও। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ইরানের বিরুদ্ধে ভোট দিলেও ইউপিএ সরকার বরাবরই তেহরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করলেও মনমোহন সরকার প্রকাশ্য মঞ্চে বারবার ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সমালোচনা করেছে। গত দশ বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রীরা ধারাবাহিক ভাবে তেহরান সফরে গিয়েছেন। কূটনীতিকদের মতে, তেল-গ্যাস ইতাদি ক্ষেত্রে ইরানের উপর ভারতের নির্ভরশীলতা আগামী দিনগুলিতে বাড়বে বই কমবে না।
ভারতের আমদানি করা তেলের ২০ শতাংশ আসে শুধু ইরান থেকেই। তাই নিয়েও গত এক বছর ধরে তীব্র টানাপোড়েন চলেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তেহরানকে তেলের দাম দিতে পারছিল না ভারত। যে আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে তেলের দাম দেওয়া হত, ওয়াশিংটনের নির্দেশে সেগুলো সবই তেহরানকে অর্থ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সম্প্রতি সাউথ ব্লকের সক্রিয় কূটনীতিতে সেই জট ছাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সময়ে ইরান যে ‘ধৈর্য’ দেখিয়েছে সে জন্য সে দেশের নেতৃত্বকে সাধুবাদ জানিয়েছে ভারত। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ইরানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। খুব শীঘ্রই ইরান সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর।
ইরানের রাজপরিবার এবং সাহিত্যানুরাগীদের সঙ্গে ২৫ বৈশাখ কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, নিজের দেশে শুধুমাত্র আত্মীয়রাই এই দিনে তাঁর কাছে আসে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে পাওয়া এই সম্মান তাঁকে প্রকৃত অর্থেই এক বিশ্বমানব করে তুলল। ইরানের কবি হাফিজের প্রতিও রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত অনুরাগ ছিল। এখন রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও বাড়বে বলে আশা করছে বিদেশ মন্ত্রক। |