হিসেব গোলাচ্ছেন অমিতই, পাল্টা যুক্তিতে যুদ্ধ জারি রাখলেন অসীম
রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করার কোনও দরকার তাঁর নেই। কারণ বাজেটের সব বই-ই তাঁর হাতে এসেছে। বাজেট বইয়ের সংখ্যাগুলির ‘নিঃশব্দ কথা’ মন দিয়ে শোনার পরে নিজের বক্তব্যে তিনি অনড়। শুধু তা-ই নয়, অস্পষ্টতা থাকা পর্যন্ত ক্লান্তিহীন ভাবে বিষয়টি বুঝিয়েও যাবেন।
বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে অমিত মিত্রের দাবির পাল্টা জবাব দিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বুঝিয়ে দিলেন, সংখ্যাযুদ্ধ জারিই থাকবে।
প্রশ্ন হল, রাজ্যের উন্নয়ন খাতে মোট আয়ের কত শতাংশ থাকে, ৬ না ৩৭? সম্প্রতি দিল্লিতে কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের হাতে উন্নয়নের জন্য ৬ শতাংশের বেশি টাকা থাকে না বলে অভিযোগ করার পরে তথ্য দিয়ে সেই বক্তব্য খারিজ করার চেষ্টা করেছিলেন অসীমবাবু। মঙ্গলবার মহাকরণে বসে পাল্টা তথ্য দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিতবাবু। এ দিন সরকারের দাবি ফের ওড়ালেন অসীমবাবু।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর দাবি খারিজ করতে গিয়ে মঙ্গলবার বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ঈষৎ তির্যক মন্তব্য ছিল, “বাজেটের সব ক’টা বইয়ের পুরোটা বোধ হয় ওঁর পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। তাই হিসেবে গোলমাল করে ফেলেছেন। আমাকে ফোন করলেই সব তথ্য দিয়ে ওঁকে বুঝিয়ে দিতাম। আর তাতে আমি খুশিই হতাম।” এ দিন সেই কটাক্ষ ফিরিয়ে অসীমবাবুর পাল্টা মন্তব্য, “ফোন করার দরকার কী? বাজেটের সব বই আমি পাই। মন দিয়ে পড়িও।”
চিত্রণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
এই চাপানউতোরের মধ্যে যে বিষয়টি ঘিরে ধোঁয়াশা থেকেই গেল, তা হল, এ রাজ্যে উন্নয়ন খাতে ঠিক কত টাকা থাকে। সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকারের মতে, মাত্র ৩,৪৩১ কোটি টাকা। আর সদ্য বিদায়ী সরকার পক্ষের দাবি ৩২,৭১২ কোটি টাকা। রাজ্যের বেহাল আর্থিক অবস্থা নিয়ে মমতার বক্তব্যকে সমর্থন করে মঙ্গলবার অমিতবাবু বলেছিলেন, সরকারের আয়ের ৯৪ শতাংশই চলে যায় কর্মীদের বেতন, পেনশন, ঋণের সুদ ও আসল মেটাতে। নির্দিষ্ট প্রকল্প বাবদ কেন্দ্রের কাছ থেকে যে অর্থ আসে (পরিভাষায় যাকে বলে ব্লক্ড ফান্ড, যা দিয়ে বেতন-পেনশন মেটানো যায় না) তাকে আয় হিসেবে দেখাতে রাজি হননি তিনি।
অমিতবাবুর এই পরিসংখ্যানকে ‘হিসাবশাস্ত্রের পরিপন্থী’ বলে মনে করছেন অসীমবাবু। তাঁর যুক্তি, অথর্মন্ত্রী রাজস্ব (রেভিনিউ) খাত ও পুঁজি (ক্যাপিটাল) খাত মিশিয়ে ফেলে গোলমাল করেছেন। তাই এই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অসীমবাবুর বক্তব্য, ঋণের সুদ ও আসল কখনই এক খাতে যায় না। সুদ যায় রাজস্ব খাতে (যে তহবিলের টাকায় বেতন-পেনশন ছাড়াও প্রশাসন চালানোর দৈনন্দিন খরচ মেটানো হয়)। অন্য দিকে, আসল দেখানো হয় পুঁজি খাতে (যে টাকা খরচ হয় বাড়িঘর এবং যন্ত্রপাতি তৈরির মতো পরিকাঠামো গড়তে অর্থাৎ উন্নয়নে)। তিনি বলেন, “সরকার যদি পুঁজি খাতে খরচের হিসেব ধরে, তা হলে উল্টো দিকে পুঁজি খাতে আয়ের হিসেবও নিতে হবে। না হলে হিসেবে গোলমাল হবে।” সোজা কথায় অসীমবাবুর যুক্তি, ঋণ নিয়ে যখন উন্নয়নের কাজ করা হয়েছে, তখন তা শোধ করার হিসেব বেতন-পেনশনের সঙ্গে এক গোত্রে ফেলা হবে কেন?
অমিতের অঙ্ক অসীমের হিসেব
রাজ্যের মোট আয় রাজস্ব খাতে আয়
এর মধ্যে ব্লক্ড তহবিল পুঁজি খাতে আয় (ঋণ ইত্যাদি)
কার্যত আয় মোট আয়
বেতন, পেনশন, সুদ ও আসল মেটাতে ব্যয় বেতন, পেনশন ও সুদ বাবদ ব্যয়
উন্নয়নের জন্য থাকে পুঁজি বাবদ ব্যয় (ঋণের আসল)
(কোটি টাকার অঙ্কে) মোট ব্যয়
উন্নয়নের জন্য থাকে
হিসাবশাস্ত্রের নিরিখে অসীমবাবুর যুক্তিকে অস্বীকার করা যায় না বলে মনে করছেন, অর্থনীতিবিদদের একাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অর্থনীতিবিদের মতে, “অমিতবাবুর কাছ থেকে আরও পরিণত যুক্তি প্রত্যাশিত ছিল।” তবে “হিসাবশাস্ত্র অনুযায়ী অসীমবাবুর বক্তব্য এক দম ঠিক” মন্তব্য করেও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্স্টিটিউটের অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার বলেন, “হিসাবশাস্ত্রের ওই তত্ত্ব মানলে পুঁজি খাতে আসা অর্থ রাজস্ব খাতে খরচ করা যায় না। কিন্তু আমরা অতীতে বারবার এই নীতি লঙ্ঘিত হতে দেখেছি। পুঁজি খাতে আসা অর্থ দিয়ে বেতন দেওয়া হয়েছে। তাই হিসাবটা জট পাকিয়ে গিয়েছে।”
ব্লক্ড ফান্ডকে আয় হিসেবে না দেখা প্রসঙ্গে অসীমবাবুর বক্তব্য, ব্লক্ড ফান্ড-সহ কেন্দ্রীয় উন্নয়নের টাকা তো উন্নয়নের জন্যই খরচ করা হয়। তা হলে সেই টাকাও হিসেবের মধ্যে ধরা উচিত। ফলে পুঁজি খাতে আয় ও ব্যয় ধরে অসীমবাবু যে হিসাব করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনা খাতে ব্যয় করার জন্য সরকারের হাতে থাকছে ৩২,৭১২ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে যা দাঁড়াচ্ছে ৩৭।
অমিতবাবুর হিসেবের আরও কয়েকটি বিষয় নিয়েও এ দিন মুখ খুলেছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। অমিতবাবুর অভিযোগ ছিল, রাজ্যের যে পরিমাণ ঋণ করার ক্ষমতা, বামফ্রন্ট সরকার অর্থবর্ষের প্রথম দু’মাসেই তার অর্ধেক তুলে নিয়েছে। অসীমবাবু এ দিন গত পাঁচ মাসের হিসেব দাখিল করে বলেন, “জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত নতুন সরকার মোট ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ
নিয়েছে। উল্টো দিকে, আগের বছর ওই পাঁচ মাসে রাজ্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।” অসীমবাবুর দাবি, বছরের প্রথম মাসগুলিতে কর আদায়ের পরিমাণ কম থাকে বলে সরকারকে ঋণের উপর বেশি করে নির্ভর করতে হয়। পরে কর আদায় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কমতে থাকে। তাই প্রথম দু’মাসের হিসেব দেখিয়ে কোনও কিছু প্রমাণ করা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে কয়েক মাসের একটি সময় ধরে হিসেব করাই যুক্তিযুক্ত। একই ভাবে রাজ্য সরকারের কর্মীদের মহার্ঘভাতা দেওয়ার প্রসঙ্গে অসীমবাবুর বক্তব্য, আগের সরকার সব সময়, কিছু দিন পরে হলেও, বকেয়া মহার্ঘভাতা দিয়ে এসেছে। ফের ক্ষমতায় এলে এ বারও অগস্ট মাসে বকেয়া দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন তাঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.