গরিষ্ঠতা নিয়ে দড়ি টানাটানিতে চার মাস ধরে কার্যত অচল মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ। সব রকমের উন্নয়নমূলক কাজই এক রকম বন্ধ। সভাধিপতি ও কর্মাধ্যক্ষেরা অবশ্য নিয়মিতই দফতরে যাচ্ছেন। কিন্তু এই জট কবে খুলবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এমনকী রাজনৈতিক দলগুলিও এই ব্যাপারে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
এই জেলা পরিষদের ৬৩টি আসনের মধ্যে ৪টি শূন্য। আপাতত বামফ্রন্টের হাতে রয়েছে ৩১টি। কংগ্রেসের হাতে রয়েছে ২৮টি। কিন্তু সাংসদ বিধায়ক সহ মোট সাধারণ পদাধিকারী সদস্যদের ১০৮ জনের মধ্যে কংগ্রেসের পক্ষে রয়েছেন ৫৭ জন। কংগ্রেসের মোট বিধায়ক ১৪ জন। রয়েছেন তৃণমূলেরও এক জন বিধায়ক। কিন্তু মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিলে জেলা পরিষদে ভোটাধিকার থাকে না। ফলে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটে ভোটাধিকার রয়েছে ১২ জন বিধায়কের। তাঁরা সকলেই কংগ্রেসের। এ ছাড়া রয়েছেন তিন সাংসদ (জঙ্গিপুরের সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায় মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নেওয়ায় ভোটাধিকার নেই)। এবং ১৪ জন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। মোট ৫৭ জন। এই হিসাবে বামফ্রন্টের হাতে রয়েছেন ৫১ জন। পঞ্চায়েত বিধি অনুযায়ী স্থায়ী সমিতি সহ জেলা পরিষদের চালিকা শক্তির চাবিকাঠি সাধারণ সদস্যের হিসেবে তাই কংগ্রেসেরই নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায় সিপিএম ও কংগ্রেস দু’টি দলের কেউই জেলা পরিষদের এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে রাজি নয়।
এই দ্বন্দ্বই কার্যত জেলা পরিষদের এই অবস্থার জন্য দায়ী। দু’পক্ষই মুখে আলোচনার কথা বললেও দু’পক্ষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
জেলা পরিষদের সভাধিপতি পূর্ণিমা দাস বলেন, “এই অচলাবস্থার জন্য ষোলো আনা দায়ী কংগ্রেস। দল ভাঙিয়ে জেলা পরিষদে অস্থিরতা তৈরি করেছে তারাই।” তাঁর দাবি, “বিরোধী দলের যে সহযোগিতা থাকা দরকার, কংগ্রেস তা দেখাচ্ছে না বলেই জেলা পরিষদের এই সঙ্কট।” তবে উন্নয়নের প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য, “গত ২৩ জুলাই আমরা পঞ্চায়েত বিধি মেনেই বাজেট সভা করেছি। কিন্তু জেলা প্রশাসন সেই সভাকে অনুমোদন দেয়নি। আমরা তখন ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছি। এখন মামলার রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ফলে চেয়ারে থেকেও কিছু করতে পারছি না।” |
অন্য দিকে জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা বাণী ইস্রাইল বলেন, “পঞ্চায়েত বিধি অনুযায়ী জেলা পরিষদের সব মিলিয়ে ১০৮ জন সদস্যের মধ্যে কংগ্রেসের ৫৭ জন। কাজেই স্থায়ী সমিতি সহ জেলা পরিষদের কোনও সভাতেই গরিষ্ঠতা নেই বামেদের। সে ক্ষেত্রে কোনও মতেই বাজেট পাশ করানো যাবে না জেনেও তারা কর্মাধ্যক্ষ সহ স্থায়ী সমিতিগুলি জোর করে দখল করে রেখেছে। গণতন্ত্রের মর্যাদা দিতে তাদেরই উচিত স্থায়ী সমিতিগুলি থেকে কর্মাধ্যক্ষদের পদত্যাগ করতে বলা।”
কিন্তু বাজেট পাশ না হলে যে অচলাবস্থা তৈরি হবে, তা কি তাঁরা জানতেন না? বাণী ইস্রাইল বলেন, “আমরা সে কথা জানি। কিন্তু সভাধিপতির কি উচিত ছিল না, বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আগেই আলোচনা করে সহযোগিতা নিয়ে সমস্যা মেটানো?” তিনি বলেন, “সভাধিপতি বরং এক তরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আমরা তাই কর্মাধ্যক্ষদের সরাতে অনাস্থা এনেছি।”
জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সিপিএমের সোমনাথ সিংহরায়ের অবশ্য বক্তব্য, “বিগত জেলা পরিষদে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। কিন্তু স্থায়ী সমিতি ও সাধারণ সদস্যের সংখ্যায় বামফ্রন্টই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবু আমরা কংগ্রেসকে সব ব্যাপারে সাহায্য করেছিলাম। কোনও কর্মাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিও আমরা তুলিনি। এ বারেও আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছি বারবার। কিন্তু তাঁরা কোনও সহযোগিতা করছেন না। ফলে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।” সোমনাথবাবু জানান, সড়ক নির্মাণের জন্য ২০০ কোটি টাকা এসে পড়ে রয়েছে। কাজ হচ্ছে না। বাণী ইস্রাইলের অবশ্য দাবি, “যে চারটি আসন শূন্য পড়ে রয়েছে, সেগুলিতে নির্বাচন হলেই সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু যেহেতু এক বছর পরেই পঞ্চায়েত নির্বাচন, তাই উপ নির্বাচন হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “উপনির্বাচন যখন এখন আর সম্ভব নয়, তখন পারস্পরিক আলোচনা করেই সমস্যা মেটানো উচিত।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক কাশীনাথ ভকতের বক্তব্য, “গণতন্ত্রে সৌজন্য ও সহিষ্ণুতার অভাব ঘটেছে বলেই এই অবস্থা।” |