বন্ধুর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে করতে গিয়ে শুরুতে সামান্য হোঁচট যেন। তবে স্মৃতির মরচে মুছে যেতে সেকেন্ড দুইয়ের বেশি লাগল না। বললেন, “ওর সঙ্গে ঠিক কত বছর আগে দেখা হয়েছিল মনে করতে পারছি না। কিন্তু এখানে কখন দেখা হবে তার অপেক্ষায় আছি। বন্ধুত্বটা নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া যাবে।” ‘বন্ধু’ সচিন তেন্ডুলকরের অপেক্ষা করে আছেন তিনি। তাঁর জন্য আ-সমুদ্র হিমাচলের অপেক্ষা অবশ্য শেষ হল আজ। ধূলো ওড়া রুক্ষ গ্রেটার নয়ডার এক ধূ ধূ প্রান্তরের বুকে যে এক টুকরো আন্তর্জাতিক গ্রাম তৈরি হয়েছে, সেই বুদ্ধ আন্তর্জাতিক সার্কিট বৃহস্পতিবার দিনভর বুঁদ রইল শুধু তাঁকে নিয়েই। আশপাশে সারাদিনই উপস্থিত আরও চার ঝকঝকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। প্রত্যেকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। প্রত্যেকে নজরকাড়া মেগাতারকা। তবু বিয়াল্লিশের মাইকেল শুমাখারের সূর্যের সামনে ফার্নান্দো অ্যালোনসো, লুইস হ্যামিল্টন, জেনসন বাটন এমনকী সেবাস্তিয়ান ভেটেলও যেন কিছুটা ম্লান।
তিনি কী বললেন, কী করলেন, একটা অটোগ্রাফ, নিরাপত্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর সঙ্গে একটা ছবি, পাশে পাশে পা-ফেলে একটু হাঁটা... উন্মাদনা শব্দটাকে রক্ত-মাংসে দেখতে বুঝি এই রকমই লাগে! দোষ কাকে দেবেন? ভারত যে ফর্মুলা ওয়ানকে চিনেছে শুমাখারের প্রেমে পড়েই।
সকালে জে পি গোষ্ঠীর গল্ফ এবং স্পা রিসর্ট জে পি গ্রিনসেই হোক, বা দুপুরের পর থেকে বুদ্ধ আন্তর্জাতিক সার্কিটের নানা অনুষ্ঠানে, সর্বত্র এই ছবিটার ফেরবদল হল না। ফর্মুলা ওয়ান কিংবদন্তির দিকে যত প্রশ্ন ধেয়ে এল তার পাশে অন্যদের জন্য জিজ্ঞাস্যগুলো হাতের প্রথম দু’টো আঙুলের করে গুনে ফেলা যায়। গতির উৎসবে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা যেন তিনি। আর বাঁশিওয়ালার দল, মার্সিডিজ বেশ তারিয়ে এটা উপভোগ করছে। এতটা আবেগে কিংবদন্তি নিজেও একটু যেন অবাকই। বলে ফেললেন, “এত সমর্থন যে আলাদা উৎসাহ পাচ্ছি। ভারতের ফর্মুলা ওয়ান ফ্যানদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় ত্রুটি রাখব না। আমি নিজেও রেসটা দারুণ উপভোগ করব বলেই মনে হচ্ছে।” জে পি গ্রিনসে শুমাখারের পাশেই তখন বসে নিকো রোজবার্গ। ‘‘হ্যাপি দেওয়ালি’’ বলে শুরু করে জার্মান তরুণ নিজেই জানালেন অটোয় চড়ে দেওয়ালির দিল্লি ঘুরে দেখেছেন গতকাল। এবং “পাগল করা অভিজ্ঞতা। তেমনই এক্সাইটিং!” |
কিন্তু লোকে যে জানতে চায় শুমাখারের ভারত-দর্শন বৃত্তান্ত! সাত বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দেশটাকে জনতে চান। কিন্তু আগে রেস হয়ে যাক। “সবে তো কাল পৌঁছেছি। লোকজনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। রেসের পর দেশটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে।” ভারতে আপনার নিজের লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর জন্য কোনও বার্তা নেই। তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “সব পরে। আগে রেস।”
ভারত নিয়ে আগ্রহকে আপাতত ছাপিয়ে যাচ্ছে বুদ্ধ সার্কিট নিয়ে তাঁর আগ্রহ। দুপুরে সেফটি কার-এ চড়ে ট্র্যাকটা দেখার পরে বললেন, “খুব ইন্টারেস্টিং ট্র্যাক। যে ভাবে চড়াই-উৎরাই করে তৈরি করা হয়েছে, এখানে চালানোটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।” তবে আনকোরা নতুন বলেই ট্র্যাকের চরিত্র পাল্টাবে, ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর।
শুমাখারের সঙ্গে এক মততাঁর এক সময়ের ফেরারি টিমমেট,আজকাল উইলিয়ামস দলের সদস্য রুবেন্স ব্যারিকেলো। ব্রজিলীয়কে একটা ‘রেস সিমুলেটর’ উপহার দিয়েছেন তাঁরই স্বদেশি ফেরারির ফিলিপে মাসা। সেই কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহয্যে এর মধ্যেই বুদ্ধ সার্কিটের একশো ল্যাপ সেরে ফেলেছেন ব্যারিকেলো। এ দিন বললেন, “আমার বউ তো রেগে আগুন! ওটা নিয়েই সর্বক্ষণ বসে আছি বলে।” তার পর মাসার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সব তোমার দোষ!” এক চোট হাসাহাসি সেরে কাজের কথায় ফিরলেন। বললেন, নতুন ট্র্যাকে আমরা কাল থেকে যত প্র্যাকক্টিস করব,তত ট্র্যাকের চরিত্রটা পাল্টাবে। ফলে শেষ পর্যন্ত রেসে কী আশা করা যায়, কেউই জোর দিয়ে বলতে পারবে না।” সাংবাদিক বৈঠকে হাজির ইয়ার্নো ত্রুলি, মাসা, আদ্রিয়ান সুটিল, নারায়ণ কার্তিকেয়ন থেকে শুমাখার সবাইকে ভাবাচ্চে আরও একটা ব্যাপার। নয়ডার ধুলো। ধুলোয়ভরা ‘ডার্টি ট্র্যাক’-এর একটা প্রবাব রেসে পড়তে পারে, দুশ্চিন্তার এমন একটা ক্ষীণ রেখা তৈরি হয়েছে।
শুমাখার আবার ভারতের ফর্মুলা ওয়ান দর্শককে ‘খুব স্মার্ট’ বললেন। প্রশ্ন ছিল, ভারতে আসার পরেও কি আপনার মনে হচ্ছে এটা শুধই সাপুড়ে আর ভয়াবহ সব জন্তু জানোয়ারদের দেশ? “আমি কিন্তু এর মধ্যেই অনেক জন্তু দেখেছি।” বলে চোখ টিপে যোগ করলেন, “ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে লোভনীয় বাজার। এখানকার মানুষও খুব স্মার্ট। এই দেশে ফর্মুলা ওয়ানে আমি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখছি।”
জে পি রিসর্টেই হাতি দেখেছেন এ দিন। ওকানেই দলগুলোর থাকছে। আর প্রবেশ পথের সামনে সারাদিন দাঁড়িয়ে দুটো হাতি। সর্বাঙ্গে তাদের নক্সা আঁকা। জানা গেল, চালকদের একেবারে নিখাদ ভারতীয় অভ্যর্থনা জানাতেই এই বন্দোবস্ত। এখানেই শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত টানা চলবে ফর্মুলা ওয়ানের ‘আফটার পার্টি’। এই পার্টিতেই গাইতে আসছেন বিশ্ব কাঁপানো পপ তারকা লেডি গাগা।
গাগাকে নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তিনি কী পরবেন, কতটুকু পরবেন, মাংস দিয়ে তৈরি জামার মতো বিস্ফোরক কিছু পরবেন কি না, তাই নিয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব মত। কেউ কেউ কল্পনাকে খোলা ছুট দিয়ে বলছেন, ভারতে আসছেন বলে রুমালি রুটির স্কার্ট আর পনির টিক্কার বক্ষবন্ধনীও পরতে পারেন!
বুদ্ধ সার্কিটে সকাল থেকেই বিশ্বের সব প্রান্তের মিডিয়ার ঢল। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর সাংবাদিক বৈঠক। এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সেবাস্তিয়ান ভেটেল তো ওই লুইস হ্যামিল্টন। প্রত্যেকে ট্র্যাক দেখে নিচ্ছেন, পায়ে হেঁটে বা মোটর বাইকে চড়ে। আর নিজেদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করছেন ভারতীয় ট্র্যাককে। ধুলো ভাবাচ্ছে তাঁদের। রেসে সেটার প্রভাব কতদূর পড়বে, তা নিয়ে চলছে হিসেব-নিকেশ। এরই মাঝে দেশের মাটিতে ঐতিহাসিক রেসে নামার রোমাঞ্চ আতঙ্কে পরিণত নারায়ণ কার্তিকেয়নের কাছে। কারণ ফ্রি-পাস। “হাজার হাজার লোক ফ্রি পাস চাইছে। পাগল হয়ে যাচ্ছি,” বলছিলেন নারায়ণ।
এ সবের পাশাপাশি আরও আবেগের দৃশ্য। দুঃস্থ শিশুদের আঁকা ছবির উপর সই করলেন শুমাখার, ভেটেল, ফার্নান্দো অ্যালোনসো, আদ্রিয়ান সুটিল, রুবেন্স ব্যারিকেলো, ফিলিপে মাসারা। ওই ছবিগুলো পরে নিলামে তোলা হবে।
গোটা দিল্লি ফর্মুলা ওয়ান জ্বরে কাবু। হোটেল, গেস্ট হাউস ভর্তি অনেক আগেই। এখন নয়ডায় পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকার চেষ্টা চলছে। যাঁদের বন্ধুবান্ধব নয়ডায় থাকেন, তাঁদের হাবভাব অনেকটা লটারি বিজয়ীদের মতোই।
ফর্মুলা ওয়ান রেস এখন রাজধানীর নতুন রাজকীয় উৎসব। |