মার্কিন কর্পোরেট জগতের ‘বিড়ম্বিত তারকা’ হলে কী হবে আদতে তো কলকাতার মানিকতলার ছেলে। কালীপুজো-দীপাবলির সঙ্গে রক্তের টান! রজত গুপ্ত তাই কালীপুজোর পবিত্র দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন, জীবনের সব চেয়ে বড় ঝড়টির মুখে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য।
কোনও কল্পিত ব্যাখ্যা নয়। খোদ রজতবাবুর ছোটবেলার বন্ধু আনন্দ জুলকাই আজ কথাটা জানিয়েছেন। বন্ধুর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জুলকা এ দিন জানান, আইনজীবীরা তো আদালতে তাঁর হয়ে আইনি লড়াই চালাবেনই। কিন্তু মানুষের সাধ্যে যদি না কুলোয়, তবে ‘সঙ্কটতারিণী কালীর দৈবী শক্তি’ই রক্ষা করবে তাঁকে এমন বিশ্বাস থেকেই ৬২ বছর বয়সী এই বঙ্গসন্তান আত্মসমর্পণ করে এফবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন কাল। পরে ব্যক্তিগত মুচলেকায় ও ১ কোটি ডলারের বন্ডে জামিন পেলেও আপাতত তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের বাইরে যাওয়া বারণ। বিচার শুরু হবে ২০১২-এর ৯ এপ্রিল। সরকারি ভাবে আদালতে অভিযোগ পেশ হবে ৩ জানুয়ারি। তার দু’দিন পর সরকারি ও অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা আলোচনায় বসে এই মামলার প্রক্রিয়াগত দিকগুলি স্থির করবেন।
রজতবাবুর বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে জুয়াচুরির ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা ও জুয়াচুরির পাঁচটি অভিযোগ এনেছে এফবিআই। মার্কিন শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)-ও। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের মামলা করেছে। তাদের এক কর্তার বক্তব্য, দেশের বড় বড় সংস্থাগুলি তাঁকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু ওই সব সংস্থার বোর্ড মিটিংয়ে বসে তিনি তাঁর ব্যবসায়ী বন্ধুর ‘চোখ ও কান’ হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। সংস্থার গোপন খবর জেনে নিয়ে শেয়ার বাজার থেকে বিপুল ফায়দা লোটার দায়ে রজতবাবুর এই বন্ধু, রাজ রাজারত্ন বর্তমানে জেল খাটছেন। ১১ বছর কারাদণ্ড হয়েছে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত এই মার্কিন ধনকুবেরের। রাজারত্নের বিরুদ্ধে মামলা চলার সময়েই রজতবাবুর নাম জড়িয়ে পড়েছিল। অভিযোগ ওঠে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর শীর্ষ কর্তা হয়েও সংস্থার গোপন তথ্য শেয়ার-বাজারের লেনদেনে যুক্ত হেজফান্ড-কর্তা রাজারত্নকে জানিয়েছেন। গত মে মাসে রাজারত্ন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকেই রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন রজতবাবু। বন্ধু আনন্দ জুলকার কথায়, “সেই সময় খুবই বিপর্যস্ত দেখাত তাঁকে। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় প্রতিটি মুহূর্ত অস্থির হয়ে থাকতেন তিনি।” কারণ, ওই মামলায় সংস্থার খবরাখবর নিয়ে রাজারত্ন ও তাঁর কথোপকথনের টেপও পেশ হয়েছিল আদালতে। ওয়াল স্ট্রিটে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে যায় এ নিয়ে। যদিও এসইসি রজতবাবুর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসে। সেটা অগস্ট মাস। বন্ধুর পক্ষে খবরটা স্বস্তির মনে করে সে সময় রজতবাবুকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন আনন্দ জুলকা। কিন্তু উদ্বিগ্ন রজতবাবু তাঁকে সাফ বলে দেন, “আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। সময় আসেনি জমিয়ে উৎসব করারও। আমেরিকা এখনও আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে।”
আনন্দ জুলকা আজ জানিয়েছেন, তাঁর বাল্যবন্ধুটি নিজেকে নির্দোষই মনে করেন। তবু তাঁর উদ্বেগের অন্যতম কারণ এখন ঘটনাচক্রে ভারতীয়-মার্কিন এক মহিলা। প্রীত ভারারা। বছর ৪৩-এর এই মহিলা নিউ ইয়র্কের সার্দান ডিস্ট্রিক্টের অ্যাটর্নি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী। প্রীত ওই পদে এসেছেন ২০০৯ সালে। তার কিছু দিন পরই (অক্টোবর মাসে) গ্রেফতার হন রাজারত্ন। সংস্থার ভিতরের লোক হয়ে শেয়ার-ব্যবসায় জড়িত থাকা (ইনসাইডার ট্রেডিং) নিয়ে এফবিআই তদন্ত শুরু করেছিল সেই ২০০৭ সালে। কিন্তু প্রীত অ্যাটর্নি হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অভিযোগ দায়ের হয়েছে মোট ৫৬ জনের বিরুদ্ধে। তালিকায় শেষ সংযোজন মার্কিন কর্পোরেট জগতের ভারতীয় তারকা রজত গুপ্ত। তদন্তের জাল আরও ছড়াচ্ছে। রজতবাবুর সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রীত বলেছেন, “সংস্থার ভিতরের খবরাখবর জানাতে তিনি যে কতটাই উদ্গ্রীব ছিলেন, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দু’টি ক্ষেত্রে। দেখা গিয়েছে কথা বলতে বলতে দু’বার তিনি থমকে গেলেন। বন্ধুকে বলার আগে গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিজে ভাল ভাবে বুঝে নেওয়ার জন্যই থমকে গিয়েছিলেন তিনি। দু’দফা মিলিয়ে মোট ৩৯ সেকেন্ড।”
মোট ছ’দফা অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোট ১০৫ বছর জেল হতে পারে রজতবাবুর। তাঁর আইনজীবী গ্যারি নাফতালিসের দাবি তিনি নির্দোষ। আদালতে সেই দাবিই করেছেন রজতবাবু। বাইরে বেরিয়ে মুখে হাসি দেখে গেলেও আদালতে মুখ ছিল থমথমে।
হালকা নীল রঙের জামা। লাল রঙের টাই। কালীপুজোর দিনে আত্মসমর্পণের জন্য নীল-লালের এই ‘কম্বিনেশন’ বেছে নেওয়াটা কি নেহাতই সমাপতন!
নাকি এর পিছনেও চেতনে-অবচেতনে কালীর শ্যামা রূপের কোনও ভাবনা রয়েছে! এ প্রশ্নটা অবশ্য আর করা হয়নি বাল্যবন্ধু আনন্দ জুলকাকে। |