|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
পঞ্চায়েত রাস্তা বানালে শিল্পায়ন হওয়া কঠিন |
ভাল রাস্তাঘাট তৈরি না হলে বিনিয়োগ আসবে না। রাস্তাঘাট
পরিকাঠামোতে আমরা অন্য রাজ্যের তুলনায় ঠিক কী অর্থে পিছিয়ে আছি?
অতীতের রাস্তা-নির্মাণ নীতির গলদ কোথায় ছিল? অভিরূপ সরকার |
জমি অধিগ্রহণ নীতি নিয়ে জাতীয় স্তরে যতই তর্ক-বিতর্ক জমে উঠুক না কেন, এটা ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ব্যক্তিগত শিল্প উদ্যোগের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি এবং নৈতিক ভাবাবেগ দুই-ই আছে। যাঁরা মনে করছেন, বহুখণ্ডিত জমির দেশ এই পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগপতির পক্ষে একলপ্তে অনেকটা জমি কেনা অত্যন্ত সময় ও খরচসাপেক্ষ, অতএব নীতি হিসেব গ্রহণযোগ্য নয়, তাঁরা সম্ভবত ভেবে দেখছেন না যে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে সরকারকেও একই খরচ বহন করতে হবে। সে সব দিন আর নেই, যখন শুধুমাত্র ক’দিনের নোটিশ দিয়ে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে নিতে পারত। এখন, পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বস্তুত সারা দেশেই আলাপ-আলোচনা করে একটা ন্যূনতম ঐক্যমত্যে না পৌঁছতে পারলে জমি অধিগ্রহণ অসম্ভব। এই সব আলাপ-আলোচনা একই রকম খরচ ও সময়সাপেক্ষ। তাই প্রশ্ন ওঠে, কারখানাটা যদি ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, তা হলে তার জন্য জমি অধিগ্রহণের খরচ সরকার অর্থাৎ জনগণ বহন করবে কেন? যাঁরা ভাবছেন, খোলা বাজারে জমি কেনা বাধ্যতামূলক হলে উদ্যোগপতিদের সাহায্যার্থে একটা পেশিজীবী দালাল শ্রেণির প্রাদুর্ভাব ঘটবে, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, এখন কৃষকরা জমির ব্যাপারে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ, গায়ের জোরে তাঁদের জমি কেড়ে নেওয়া আর সহজ নয়। উল্টো দিকে, আইনি নোটিশ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করার আড়ালে যে একটা রঘু ডাকাত-সুলভ মানসিকতা লুকিয়ে আছে, সেটা বোঝবার সময়ও এখন এসেছে। সব থেকে বড় কথা, কৃষকদের মতো ক্ষুদ্র ও দুর্বল মানুষদের ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর পেছনে একটা নৈতিক ভাবাবেগ কাজ করে, যার সমর্থন রবীন্দ্রনাথ এবং গাঁধী থেকে শুরু করে আরও বহু মনীষীর চিন্তায় পাওয়া যাবে।
|
উন্নয়নের রাস্তা |
এই নিবন্ধ জমি অধিগ্রহণের ভাল-মন্দ নিয়ে নয়, উন্নয়নের নৈতিকতা নিয়েও নয়। এই রচনার উদ্দেশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। এখানে প্রাথমিক প্রশ্ন হল, বেসরকারি উদ্যোগের জন্য জমি উদ্যোগপতির হাতে তুলে দেওয়া না হলে কি উদ্যোগপতি এই রাজ্যে বিনিয়োগ করার উৎসাহ অনুভব করবেন? প্রশ্নটা অস্বস্তিকর, বিশেষ করে এই কারণে যে, অন্যান্য অনেক রাজ্য এখনও জমি অধিগ্রহণ করে সেই জমি উদ্যোগপতির হাতে তুলে দিতে রাজি আছে। এই অবস্থায় শিল্পপতিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে সরাসরি বাজার থেকে জমি কিনে কারখানা করতে রাজি হবেন কি? |
|
বেহাল রাস্তা। পশ্চিম মেদিনীপুরে জাতীয় সড়ক ৬০। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল |
কেনার মতো জমি যে আমাদের রাজ্যে নেই, তা নয়। কলকাতা থেকে দূরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমে বহু রুক্ষ জমি পড়ে আছে। কলকাতার কাছে কল্যাণীতে পড়ে রয়েছে বন্ধ কলকারখানার জমিগুলো। এই সব জায়গায় শিল্প না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ রাস্তার অভাব। শিল্পপতি যখন একটা কারখানা স্থাপন করেন, তখন দু’ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা তাঁর মাথায় থাকে। এক, তিনি যাচাই করে নেন, কাঁচামালের উৎস থেকে তাঁর কারখানায় পৌঁছনোর রাস্তাটা ঠিকঠাক আছে কি না। দুই, তিনি দেখে নেন, উৎপাদিত পণ্য কারখানা থেকে বাজারে নিয়ে যাবার পথটা কতটা সুবিধাজনক। আমাদের রাজ্যে চওড়া, দ্রুতগতিসম্পন্ন রাস্তার বড়ই অভাব। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া থেকে কলকাতার বন্দর কিংবা রেলস্টেশনে পৌঁছনো সহজ কাজ নয়। আর সাম্প্রতিক কালে কলকাতা থেকে কল্যাণী যাবার অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে, তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন, রাস্তায় বড় বড় খানাখন্দ তৈরি হওয়ার কারণে দেড় ঘণ্টার পথ এখন তিন-চার ঘণ্টাতেও পৌঁছনো যাচ্ছে না। এই ভাবে শিল্পায়ন হওয়া অসম্ভব।
অর্থাৎ, আমরা বলতে চাইছি, ভাল রাস্তাঘাট তৈরি না হলে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ আসবে না। কথাটা নতুন নয়, রাস্তঘাটের অপরিহার্যতার কথা ওপর-ওপর আমরা সকলেই জানি। কিন্তু ব্যাপারটা আরও ভাল করে জানা দরকার। বিশেষ করে জানা দরকার, রাস্তাঘাট পরিকাঠামোতে আমরা অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় ঠিক কী অর্থে পিছিয়ে আছি এবং অতীতে আমাদের রাস্তা-নির্মাণ নীতির গলদটা কোথায় ছিল। এই সব জানতে গেলে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে আমাদের তাকাতেই হবে।
সংলগ্ন সারণিতে ভারত তার সতেরোটি রাজ্যের রাস্তা সম্পর্কিত কিছু তথ্য দেওয়া আছে। এগুলো সবই জনসংখ্যার বিচারে বড় রাজ্য। অর্থাৎ, সারণিতে স্থান পাওয়া প্রতেকটি রাজ্যেরই জনসংখ্যা ২০০৮ সালে ২ কোটিরও বেশি ছিল। যেহেতু রাজ্যগুলির আয়তন সমান নয়, তাই সরাসরি তাদের মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য তুলনা করা যায় না। তুলনা করা যায় প্রতি একশো বর্গকিলোমিটারে রাজ্যগুলিতে কতটা রাস্তা আছে। সারণিতে দ্বিতীয় কলামের দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে, এই নিরিখে সারা ভারতের তুলনায় তো বটেই, অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনাতেও পশ্চিমবঙ্গে মোট রাস্তা নেহাত কম নেই। বস্তুত, একশো বর্গকিলোমিটার প্রতি মোট রাস্তা অনুযায়ী রাজ্যগুলোকে সাজালে সতেরোটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান চতুর্থ।
|
|
সমস্যা হল, মোট নির্মিত রাস্তার সঙ্গে শিল্পায়নের কোনও সরাসরি সম্পর্ক আদৌ দেখা যাচ্ছে না। কিলোমিটার প্রতি রাস্তা সব থেকে বেশি উত্তরপ্রদেশ, কেরল, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গে। এদের কাউকেই শিল্পের দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত বলা চলে না।
আসলে, যে কোনও রাস্তা থাকলেই শিল্পায়ন হয় না, রাস্তা শিল্পায়নের উপযোগী হওয়া দরকার। রাস্তা যদি কাঁচা ও সরু হয়, তার ওপর দিয়ে ভারী ট্রাক চালানো যাবে না। বর্ষাকালে সেই রাস্তা লোক চলাচলেরও অযোগ্য হয়ে উঠবে। ফলে কাঁচা মাল নিয়ে আসা, শ্রমিকদের যাতায়াত, উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দেওয়া কোনও কাজেই সে রাস্তা লাগবে না। শিল্পের জন্য দরকার পাকা, চওড়া ও শক্তপোক্ত রাস্তা। যেমন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, যার ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারে।
সারণিতে তৃতীয় কলামের দিকে তাকালে শিল্পায়নের সঙ্গে রাস্তার সম্পর্কটা বোঝা যাবে। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, যে-সব রাজ্যে পাকা রাস্তার অনুপাত বেশি, সেখানে মোটের ওপর শিল্পায়ন বেশি হয়েছে। রাজ্যে পাকা রাস্তার অনুপাত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কম। বলা যেতেই পারে, এটা আমাদের রাজ্যে শিল্পায়ন থমকে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বস্তুত, পাকা রাস্তার অনুপাত অনুযায়ী রাজ্যগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে
১) গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব ও হরিয়ানা, যেখানে পাকা রাস্তার অনুপাত ৭৫ শতাংশের বেশি;
২) অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান, যেখানে পাকা রাস্তার অনুপাত ৭৫ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে;
৩) কেরল, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড, যেখানে এই অনুপাত ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে এবং
৪) অসম, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে পাকা রাস্তা ২৫ শতাংশের কম। এই শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের মানচিত্রটা মেলালে বোঝা যাবে শিল্পায়নের সিংহভাগ প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির রাজ্যগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
|
সব রাস্তা সমান নয় |
শুধু পাকা রাস্তা হলেই চলবে না, শিল্প-বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য দস্তুর মতো চিন্তাভাবনা করে বোঝা দরকার, ঠিক কোথায় কোথায় রাস্তাগুলি তৈরি হলে কলকারখানা বসাতে সুবিধা হবে। এর জন্য একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। এখন, একটি রাজ্যে নানা ধরনের রাস্তা আছে। কিছু আছে জাতীয় হাইওয়ে, কিছু রাজ্য স্তরের হাইওয়ে, কিছু পূর্ত কিংবা পুর বিভাগের, কিছু বনবিভাগের রাস্তা। তা ছাড়া, পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর। অর্থাৎ জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত। এদের প্রত্যেকের দায়িত্বে আলাদা আলাদা রাস্তা রয়েছে। রাজ্যগুলিতে তিনটি স্তর মিলিয়ে মোট কতটা রাস্তা পঞ্চায়েতের অধীনে রয়েছে, তার একটা ধারণা সারণির চার নম্বর কলাম থেকে পাওয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ওড়িশায়, যেখানে পাকা রাস্তার অনুপাত সব থেকে কম, সেখানে পঞ্চায়েতি রাস্তার অনুপাত সব থেকে বেশি। অর্থাৎ, কেরলকে ব্যতিক্রম ধরে নিলে অনায়াসে বলা যায়, পঞ্চায়েতি রাস্তার অধিকাংশই কাঁচা রাস্তা এবং পশ্চিমবঙ্গের সড়ক ব্যবস্থার মূল গলদ এইটা যে, এখানে সিংহ ভাগ রাস্তা ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা রয়েছে।
সমস্যাটা শুধু রাস্তা কাঁচা হওয়ার নয়, খণ্ডিত এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরও বটে। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের অধীনে যত রাস্তা আছে, তার ৭০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতায়। রাস্তা তৈরির ব্যাপারে একটা গ্রাম পঞ্চায়েতের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ধরে নেওয়া যায়, গ্রাম পঞ্চায়েত মূলত তার নিজস্ব ক্ষুদ্র প্রয়োজন অনুযায়ী রাস্তা বানাবে। ফলে, বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের তৈরি রাস্তার মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করা কঠিন হবে। একটু অন্য ভাবে বলতে গেলে, বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য রাস্তা তৈরির ব্যাপারে যে সার্বিক পরিকল্পনা দরকার, যার কথা আমরা একটু আগেই বলেছি, পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি হলে সেটা করা যাবে না।
মোদ্দা কথাটা, কিছু ব্যাপারে বিকেন্দ্রীকরণ বাঞ্ছনীয়, কিন্তু সব ব্যাপারে নয়। রাস্তা তৈরি এমন একটা কাজ, যেখানে বিকেন্দ্রীকরণের খুব একটা জায়গা নেই। একটা এলাকায় রাস্তা তৈরি হলে শুধু যে সেই এলাকার মানুষ উপকৃত হচ্ছেন তাই নয়, কাছে-দূরের সব মানুষ, যাঁরাই রাস্তাটা ব্যবহার করবেন, তাঁরাই উপকৃত হবেন। সড়ক পরিকল্পনার সময় এই সার্বিক উপকারের ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম নেটওয়ার্ক এক্সটারনালিটি। এটা একমাত্র তিনিই উপলব্ধি করতে পারবেন, যিনি একটু ওপর থেকে পরিকল্পনাটা করছেন। অর্থাৎ আমরা বলতে চাইছি, নেটওয়ার্ক এক্সটারনালিটি উপস্থিত থাকলে পরিকল্পনাগুলি কেন্দ্রীভূত হওয়াটাই অভিপ্রেত। অবশ্য নতুন এবং উৎকৃষ্ট মানের রাস্তা তৈরির টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা একটা মস্ত বড় প্রশ্ন।
|
লেখক কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|