সম্পাদক সমীপেষু...
ডাক্তারের অনিচ্ছা থাকলে হবেই না
ডাক্তারের ইচ্ছা থাকলেই হয় না’ (২২-৯) শীর্ষক নিবন্ধে ডা. সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল সংক্ষেপে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে গ্রামের কিছু অভিজ্ঞতার নিরিখে চিকিৎসা পরিষেবা বিষয়ে কয়েকটি কথা তুলে ধরতে চাই।
গ্রামের চাষি, খেতমজুর প্রভৃতি শ্রেণির মানুষরা প্রায়ই বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর হার খুব বেশি। কারণ, গ্রামীণ হাসপাতালে এ ভি এস থাকে না। এগুলি রাখা হয় জেলা শহরের চিকিৎসাকেন্দ্রে। বেশির ভাগ রোগীদের কলকাতায় রেফার করেন গ্রামের চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুরা। এর দুটি কারণ একটি হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব এবং অপরটি হল, যে কোনও সময় বিপদ ঘটলে বা রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটলে চিকিৎসাকেন্দ্রের উপর হামলা করার মানসিকতা এখন প্রচণ্ড। রাজনৈতিক সমর্থনের আশায় হাঙ্গামাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না-নেওয়ার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং চিকিৎসকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা দাদাদের হাতের মুঠোয় যেখানে, তখন কেন চিকিৎসকরা বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন।
এ ছাড়া, দীর্ঘ দিনের গ্রামীণ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলির প্রতি অবহেলা ও পরিকল্পনার অভাবের জন্য যে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে একটি খেতমজুর-পরিবারও যে-কোনও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না-গিয়ে স্থানীয় নার্সিংহোমে যায় নানা ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েও। এতটা অনাস্থা সরকারি ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ করা যায়।
রাজ্যের মানুষের উপর মাথাপিছু সরকারি ঋণ যেখানে তিরিশ হাজার টাকা, তা হলে কেন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বরাদ্দ করা হবে না? কেন ঘটি-বাটি বিক্রি করে বাঁচার জন্য মানুষকে লাইন দিয়ে দক্ষিণ ভারতে ছুটতে হবে? প্রতি বছর আমাদের রাজ্য থেকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে চিকিৎসার জন্য মানুষ দক্ষিণ ভারতে চলে যায়। প্রয়োজনে মানুষ আরও বেশি টাকা খরচ করতেও চায়, যদি উন্নত ও অবশ্যই মানবিক পরিষেবা পাওয়া যায়। চিকিৎসকদের আরও অনেক বেশি ধৈর্যশীল, সহনশীল ও মানবিক হতে হবে এবং লোভের পরিমাণ কমাতে হবে। দক্ষিণের রাজ্য থেকে চিকিৎসা করে আসা মানুষেরা দুটি বিষয়ের কথা বলেন প্রথমত, সেখানে পরিষেবার মধ্যে স্নেহ, মানবিকতা ও সেবার মানসিকতা আছে, আমাদের রাজ্যে যার একান্ত অভাব। দ্বিতীয়ত, সেখানকার পরিকাঠামো খুবই উন্নত, সরকারি ক্ষেত্রেও। নতুন সরকারের কাছে মানুষের আশা, সরকারি চিকিৎসা পরিষেবাকে প্রকৃতপক্ষে সেবাধর্মের মানসিকতায় উন্নত করে তুলুন। তার ওপর গরিব এবং মধ্যবিত্ত মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনুন।


যেখানে অন্যায় সহ্য করে নেওয়াই নিয়ম
২৮ অগস্ট রবিবাসরীয়তে স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘পত্রপাঠ জবাব’ নিবন্ধ পড়ে মনে হল, আমরা বেঁচে আছি নিঃসীম এক ভীরুতা নিয়ে, পরিবারের পিছুটান নিয়ে। তবুও মাঝেমধ্যে এক স্থানীয় পত্রিকায় তুলে ধরতাম কিছু কিছু সংবাদ। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় দীর্ঘ দিন পড়েছিল জরাজীর্ণ অবস্থায়। শিশুদের মাথার উপর জল পড়ত, চৈত্রের ঝড়ে ধুলোয় ঢেকে যেত সব। অথচ বিদ্যালয় মেরামতের টাকা রাখা ছিল তৃতীয় সারির এক নেতার হাতে। কয়েক জন মিলে সেটার সুলুক-সন্ধান করতেই প্রধান ভূমিকায় যে ছিল, সে হুমকি খেল: ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে বডি রেললাইনের ধারে পড়ে থাকবে’। আরেক বার স্থানীয় একটি নামকরা হোটেলে শ্রমিক কর্মীদের উপর মালিকের দুর্ব্যবহার ও বঞ্চনার কথা সমবেত ভাবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হওয়ার খবর পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশ করি। ফলে, ওই হোটেলের মালিক তাঁদের নেতাকে নালিশ করেন। নেতামহাশয় পত্রিকার সম্পাদককে কড়া হুকুম দেন, খবরদার! আমার এলাকার কোনও খবর আমার অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করবেন না।
মধ্যপ্রদেশে যেমন চন্দন-দস্যুরা এবং তথাকথিত দেশসেবকরা সক্রিয়, এখানেও তেমনই কয়লা-মাফিয়ারা অতি সক্রিয়। পিছনে কে বা কারা, সবাই জানেন। কিন্তু কে আর ‘সেলহা মাসুদ’ হতে চায়! বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে আছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে জি টি রোডে পিষ্ট হয়ে বেঘোরে যাবে এই নিরীহ প্রাণটা।
অন্যায় সইতে সইতে মনে হয়, এটাই নিয়ম। চক্রব্যূহে ঢোকার পথটাই আছে, বের হওয়ার পথটা বেদব্যাসেরও জানা ছিল না।
আমরা তাই বন্দি হয়েই আছি।
নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন যাঁরা শুরু করেছিলেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পাক্ষিক কলমে (৫-১০) লিখেছেন, ‘সুহৃদ রুদ্র আর পরিমল চন্দ্র নামে দুই ভদ্রলোক ষাটের দশকে শুরু করলেন নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সংগীত উৎসব’। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন নামটা ঠিক তাঁর মনে নেই। আসলে নামটি হচ্ছে নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন (সংগীত উৎসব নয়)। শুরু করেছিলেন বর্তমান পত্রলেখক এবং পরিমল চন্দ্র, ১৯৪৮ সালে। ষাটের দশক শুরু হতে তখনও বারো বছর বাকি। এই সম্মেলনের অষ্টাহকালব্যাপী অধিবেশন হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পঁচিশে বৈশাখ থেকে। শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রকাশ্যে সর্বসাধারণের জন্য কবিগুরুর জন্মোৎসব উদ্যাপনের সেটাই প্রথম প্রচেষ্টা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান করার অনুমতি যাঁর চেষ্টায় পাওয়া গিয়েছিল, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন কর্ণধার সুরেশচন্দ্র মজুমদার। আর সুরেশচন্দ্রের কাছে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তর কলকাতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী অমর বসু (জংলিদা)। জংলিদা ছিলেন সুরেশচন্দ্রের অকৃত্রিম সুহৃদ।
এই জন্মোৎসব পালনে বিভিন্ন মহলেই প্রভূত উৎসাহের সঞ্চার হয়। পরের বছর আরও বড় জায়গায় মহাজাতি সদনে এই অধিবেশন করার কথা ভাবলাম আমরা। মহাজাতি সদনের তখনও ছাদ তৈরি হয়নি। সেখানে অনুষ্ঠান করা তো খুবই ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। উত্তর কলকাতার বনেদি বিত্তবান পরিবারের সন্তান সাহিত্য যশপ্রার্থী সুহৃদ রুদ্রর কথা ভাবা হল। পরের বছর সম্পাদক নিযুক্ত হলেন সুহৃদ রুদ্র এবং পরিমল চন্দ্র। অনুষ্ঠান হল মহাজাতি সদনে।
মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠানের অনুমতির জন্যও সুরেশচন্দ্র মজুমদারের সাহায্য অবশ্য স্মরণীয়। এখানে অনুষ্ঠান করতে যে বাড়তি খরচ হল, সুহৃদ রুদ্র পরবর্তী কালে সেই দায়ভার গ্রহণে অস্বীকার করায় পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালে নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তাহকালব্যাপী অনুষ্ঠান করা হল জোড়াসাঁকো রাজবাটিতে। সম্পাদক বর্তমান পত্রলেখক এবং পরিমল চন্দ্র। পরের বছর আবার সুহৃদ রুদ্র ফিরে এলেন। এর পর ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মহাজাতি সদনেই অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। সভাপতি ছিলেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত। ১৯৫৩ সাল থেকেই সুহৃদ রুদ্র নিজেকে সরিয়ে নিলেন। ১৯৫৪ সাল থেকে আমরাই শুরু করলাম বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন। এর কর্মকাণ্ড আরও ব্যাপক। মূল সংগঠক অবশ্যই পরিমল চন্দ্র। ১৯৫৫ সালের পর থেকে নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন বন্ধ হয়ে যায়।
সন্তোষকুমার ঘোষ এবং দেবব্রত বিশ্বাসের মনান্তর সম্পর্কে সুনীল যা লিখেছেন সে প্রসঙ্গে একটি কৌতুককর ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। সালটা ঠিক মনে নেই। সম্ভবত সত্তর দশকের মাঝামাঝি। রবীন্দ্র সদনে দেবব্রত বিশ্বাসের একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। শ্রোতাদের মধ্যে সন্তোষকুমার ঘোষও উপস্থিত ছিলেন। দেবব্রত প্রথমেই গাইলেন ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’। দ্বিতীয় গানটি আরম্ভ করার আগেই তিনি দেখতে পেলেন আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট প্রথম সারিতে উপবিষ্ট সন্তোষকুমার ঘোষকে। এ বার তিনি শুরু করলেন, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’র গানটি। ‘বৃষ্টিনেশাভরা সন্ধ্যাবেলা কোন বলরামের আমি চেলা’ পর্যন্ত গেয়ে দেবব্রত একটু থামলেন। তার পরেই শুরু করলেন, ‘আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে যত মাতাল জুটে’ এবং একই লাইন বার বার গাইতে লাগলেন। যেন পিন আটকে যেতে গ্রামোফোন রেকর্ডটি একই জায়গায় ঘুরছে। সন্তোষকুমার গান শেষ হতেই উঠে গেলেন।
হাঁড়িয়া
আমার ‘জাগো দুর্গা’ (১৩-১০) চিঠিটির পর শঙ্খমণি গোস্বামীর ‘হাঁড়িয়া মানে’ শিরোনামায় প্রকাশিত চিঠিটি পড়লাম। এ বিষয়ে বলি:
শঙ্খমণি গোস্বামীর চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘খেজুরের রস গেঁজিয়ে উঠে তৈরি হয় তাড়ি’। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আমার জন্ম বর্ধমান জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম শ্রীপাট বাঘনাপাড়ায়। বাল্য ও প্রথম কৈশোর সেখানে কেটেছে। গাঁয়ের ছেলে হিসেবে খেজুর রস গেঁজিয়ে তাড়ি তৈরি হতে দেখিনি। আমাদের পল্লিগ্রামে তাড়ি তৈরি হত তালের রস গেঁজিয়ে। উৎসের দিক থেকে এটাই ঠিক। তাড়ি শব্দটি এসেছে তাল-এর সংস্কৃত রূপ তালী থেকে। কালিদাসের রঘুবংশম মহাকাব্যের ত্রয়োদশ মার্গে এর উল্লেখ আছে। ‘তমাল তালী বনরাজিনীলা’ তালি>তাড়ি। ‘ল’-এর উচ্চারণ মূর্ধণ্য হওয়ায় তাড়ি। পাততাড়ি শব্দেও এর রূপ আছে। তালীপত্র>তাড়িপাত। সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাসে ‘পরনিপাতে’ ‘পাততাড়ি’।
শ্রীগোস্বামী লিখেছেন, হাঁড়িয়া হল গেঁজিয়ে ওঠা ভাত থেকে তৈরি মাল। ভাল কথা। কিন্তু হাঁড়িয়া নাম কেন? আগে মাটির হাঁড়িতে ভাত পচিয়ে বা গেঁজিয়ে এটি তৈরি হত, এখন ধাতুর হাড়িতেও হয়। হাঁড়িজাত সুরা= হাঁড়িয়া।
হাঁড়িয়াকে আমাদের গাঁ গেরামে পচাই বা পচুই-ও বলা হত। ভাত পচিয়ে তৈরি তাই এই নাম। গাঁয়ে সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় বাল্যকালে দেখেছি, ঢাকিরা প্রতিদিন পচাই বা পচুই মহানন্দে খেত। এমনকী, সঙ্গের কাঁসি বাজিয়ে বালকটিও বড়দের পচাই বা পচুইয়ের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হত না। পচাই বা পচুইয়ের আর এক রূপ ধেনো (ধান্যজাত সুরা)। উনিশ শতকের বাংলা প্রহসনে এরই নাম ধান্যেশ্বরী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.