সাঁতরাগাছির ঝিলটি কাহার? প্রশ্নটি কঠিন এবং সহজ। সহজিয়া ভঙ্গিটি ঠিক মানুষের নহে। পক্ষীর। এই ঝিলে প্রতি শীতেই অজস্র পরিযায়ী পাখির আগমন হয়। তাহারা নির্ভয়ে এই ঝিলের জলে খেলা করে, বাসা বাঁধে। সুতরাং, সেই উড়ন্ত অতিথিগণ শীতের কয়েকটি মাস নির্বিবাদে এই ঝিলের স্বত্বাধিকার দাবি করিতে পারে। তাহাতে মানুষের তরফ হইতে বিশেষ আপত্তি উঠিবার কথা নহে। মানবিক সংকটটি অন্যত্র। ঝিলটি কাহার? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত এই আসন্ন শীতের লগ্নে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ মুহূর্তে ঝিলের জল কচুরিপানায় বদ্ধ। এই অবস্থাটিই চলিতে থাকিলে পরিযায়ী পাখিরা আসিবে কি না, বা আসিলেও থাকিবে কি না, সন্দেহ। সমস্যা ইহাই যে, ঝিলটি পরিষ্কার কে করিবে? বিধি কী বলিতেছে? পাখিরা অবশ্য আইনের ধার ধারে না, তাহারা ঝিলটিকে বাসা বাঁধিবার অযোগ্য অবস্থায় দেখিলে পথ পরিবর্তন করিয়া অন্যত্র উড়িয়া যাইবে। মনুষ্য-চালিত প্রশাসনই সবিশেষ সংকটে পড়িয়াছে। ঝিল আসলে কাহার?
প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের অরণ্য দফতর যাবতীয় দায় অস্বীকার করিয়াছিল। অতঃপর, জানা গিয়াছে যে জমিটি যদিও রেল বিভাগের অধীনে, কিন্তু ঝিল পরিষ্কারের কাজ রাজ্য বন দফতরই করিয়া থাকে। অর্থসংকট ও অন্য নানা বিষয় হেতু কাজটি শুরু করিতে বিলম্ব হইয়াছে। কচুরিপানার বংশবৃদ্ধি অবশ্য তাই বলিয়া থামিয়া নাই। এমন একটি পরিস্থিতিতে কিছু পক্ষী ও পরিবেশপ্রেমীর ঐকান্তিক উদ্যোগে বেসরকারি স্তরে ঝিল সাফাইয়ের কাজটি শুরু হইয়াছে। কারণ, শীত আসিতে বিশেষ দেরি নাই। পক্ষীকুলের শুভাগমনের প্রতীক্ষার ফাঁকে দুইটি বিষয় খেয়াল করা জরুরি। এক, ঝিলটির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারি দফতর বিচিত্র উলটপুরাণের নমুনা দেখাইয়াছে। ইহা অবাঞ্ছিত। অর্থসংকট থাকিতেই পারে, তাহা অস্বাভাবিক কিছু নহে। অথচ, সংশ্লিষ্ট দফতরের বক্তব্যে তথ্যের যে অসঙ্গতি দেখা গিয়াছে, তাহাই অ-স্বাভাবিক। ইহা প্রমাণ করে যে, নিজ কর্তব্যকর্ম বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথাযথ রূপে অবহিত নহে। অনবহিতিটি দুর্ভাগ্যজনক।
তৃতীয় একটি কথা আছে। ঝিল পরিষ্কার রাখিবার কাজটি নাগরিক সমাজ তুলিয়া লইয়াছে। ইহা অভিনন্দনের যোগ্য। কিন্তু, এই ধরনের কাজকর্মের জন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও একটি দায় থাকিয়া যায়। সেই কথাটি মাথায় রাখিলে এই জাতীয় কাজ করিতে গিয়া সরকারের প্রতি অভিমানী হইবার বিশেষ সুযোগ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা আত্মশক্তির উদ্বোধনের একটি কথা বলিয়াছিলেন। সেই ধরনের নিজস্ব শক্তির উদ্বোধন বস্তুত কোনও বর্হিসূত্রের সাহায্য ইত্যাদির ধার ধারে না। বিশেষ করিয়া ঝিল পরিষ্কারের ন্যায় এই জাতীয় সামাজিক কর্মে সেই আত্মশক্তিটি জরুরি। অন্যথায়, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্তির মনোভঙ্গি এক বার যদি গ্রাস করিয়া লয়, তখন কর্মকাণ্ডের পূর্বে সর্বদা একটি পিছুটান থাকিবার সম্ভাবনা প্রবল। অন্য কাহারও মুখাপেক্ষী হইবার পিছুটান। সাঁতরাগাছির ঝিলের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ একটি জরুরি কাজ করিয়াছে। সেই কাজটি সরকারি কর্তব্যের তালিকাভুক্ত, ঠিক। কিন্তু, ইহা নাগরিকদের করণীয়ও বটে। সেই বোধটি জনচিত্তে জাগ্রত থাকা উচিত। যাহা সরকারের করণীয়, তাহা সরকার না করিলে করিব না, এমন একটি চিন্তার ধাঁচ এই দেশে বহুল প্রচলিত। সেই ছাঁচটি ভাঙিয়াছে। অতঃপর, আশা করা যায়, এই দৃষ্টান্ত নূতন কোনও কর্মসংস্কৃতির সূচনা করিবে। |