রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রীদের ইউরোপ ঘুরিয়ে এনেও লাভ হল না। অভিন্ন পণ্য পরিষেবা কর নিয়ে নরম সুর নেওয়া দূরের কথা, এখন আরও বেঁকে বসেছেন তাঁরা।
আগামী আর্থিক বছর থেকেই পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করতে চান মনমোহন-প্রণব-মন্টেক। কিন্তু সদ্য অনুষ্ঠিত জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকেও যে ভাবে নতুন এই কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজ্যগুলি কড়া অবস্থান নিয়েছে, তাতে ইউপিএ-সরকারের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ জিএসটি-র মূল বিষয়টি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে রাজ্যগুলি। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা এবং মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির অভিযোগ, সংবিধান সংশোধন করে জিএসটি চালু করে রাজ্যগুলির হাত থেকে কর বসানোর ক্ষমতাই কেড়ে নিতে চাইছে কেন্দ্র।
রাজ্যগুলির এই ‘সংশয়’ দূর করতেই বিভিন্ন রাজের মুখ্যমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীদের ইউরোপে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। উদ্দেশ্য ছিল, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম বা লুক্সেমবার্গে কী ভাবে জিএসটি চালু রয়েছে, তা দেখানো। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। ইউরোপ ঘুরে এসে বিহারের অর্থমন্ত্রী সুশীল মোদী বা মধ্যপ্রদেশের অর্থমন্ত্রী রাঘবজি এ বার বলতে শুরু করেছেন, ইউরোপ ও ভারত কি এক নাকি? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই তো আলাদা। ওই সব দেশের অনুকরণে এ দেশে জিএসটি চালু করা যাবে না।
কেন্দ্রের সামনে সমস্যাটা কোথায়? জিএসটি চালু করতে গেলে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজনীয় বিলটি ইতিমধ্যেই সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেটি এখন অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে। এ বিষয়ে কমিটির চেয়ারম্যান, বিজেপি-সাংসদ যশবন্ত সিন্হারও সহযোগিতা চাইছেন প্রণব। কিন্তু রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত ‘এমপাওয়ার্ড কমিটি’ তাঁদের আপত্তির কথা স্থায়ী কমিটিকে জানিয়েছেন। যশবন্তের ব্যাখ্যা, “কর বসানোর ক্ষমতার একেবারে মূলে আঘাত করছে জিএসটি। সংবিধান অনুযায়ী, উৎপাদনের উপর কর বসাবে কেন্দ্র, বিক্রয়ের উপর কর বসাবে রাজ্য। কিন্তু জিএসটি বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’পক্ষেই দুই ক্ষেত্রে কর বসাবে। কেন্দ্র কর আদায় করে তার পরে তা রাজ্যগুলিকে বিলি করবে। স্বাভাবিক ভাবেই এতে রাজ্যগুলির আপত্তি রয়েছে। রাজ্যগুলির সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হবে।” বিজেপি ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সমর্থন ছাড়া যে জিএসটি চালু করা সম্ভব নয়, তা খুব ভাল করেই জানে অর্থ মন্ত্রক। কারণ সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করাতে গেলেও প্রধান বিরোধী দলের সাহায্য প্রয়োজন। তার পরে আবার ১৫টি রাজ্যকে ওই আইনে অনুমোদন দিতে হবে।
|
সংবিধান সংশোধনী বিলের দু’টি বিষয় নিয়ে মূলত আপত্তি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ রাজ্যগুলির। প্রথম বিষয়টি হল একটি জিএসটি-পরিষদ তৈরি করা। কোন কোন ক্ষেত্রে, কত হারে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কর বসাবে, কোথায় কর বসানো হবে, এই বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে সুপারিশ করবে এই পরিষদ। দাবি উঠেছে, পরিষদকে শুধু করের ন্যূনতম হার নিয়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হোক। প্রয়োজনে সুপারিশের থেকে বেশি হারে কর বসানোর ক্ষমতা দিতে হবে রাজ্যগুলিকে। বেশ কিছু রাজ্য এই পরিষদ তৈরিরই বিপক্ষে। কিছু রাজ্যের মত, আলাদা করে পরিষদ তৈরি না করে বর্তমানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে গড়া ‘এমপাওয়ার্ড কমিটি’-তেই কেন্দ্রের প্রতিনিধি যোগ করে দেওয়া হোক।
ওই বিলের দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে রাজ্যগুলির আপত্তি, তাতে একটি ‘ডিসপুট সেটলমেন্ট অথরিটি’ তৈরির কথা বলা হয়েছে। জিএসটি-পরিষদের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি থাকলে কেন্দ্র বা রাজ্য এই অথরিটির কাছে নালিশ জানাতে পারে। রাজ্যগুলির বক্তব্য, জিএসটি-পরিষদের সুপারিশ মানতে রাজ্য বাধ্য নয়। কাজেই এ নিয়ে অথরিটি তৈরিরও প্রয়োজন নেই।
বেশ কিছু কর জিএসটি-র মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া নিয়েও বিভিন্ন রাজ্যের আপত্তি রয়েছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ কর না থাকলেও অনেক রাজ্য প্রবেশ কর বসায়। সেই রাজ্যগুলি এই অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। গোয়া বা সিকিমের মতো রাজ্য আবার বেটিং ও জুয়ার উপর কর বসানোর অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। তাদের যুক্তি, বেটিং বা জুয়া পণ্যও নয়, পরিষেবাও নয়। তাই জিএসটি-র আওতায় এদের নিয়ে আসা চলবে না। কিছু রাজ্য আবার চাইছে, তামাক ও তামাকজাত পণ্যকে জিএসটি-র বাইরে রাখা হোক। কেন্দ্র আবার এগুলিকে জিএসটি-র আওতায় রাখছে, যাতে এর উপর প্রয়োজনে বেশি মাত্রায় উৎপাদন শুল্ক বসানো যায়। কিন্তু রাজ্যগুলি বেশি করে বিক্রয় কর বসিয়ে নিজেদের আয় বাড়াতে চায়। পঞ্জাব ও হরিয়ানা আবার খাদ্যশস্যের উপর ‘পারচেজ ট্যাক্স’ বসিয়ে প্রচুর রাজস্ব আদায় করে। তারা এই অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। ওড়িশার মতো রাজ্যগুলি আবার বলছে, কয়লা জিএসটি-র আওতায় এলে করের হার বাড়বে। ফলে বিদুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, জিএসটি-র প্রধান উদ্দেশ্য হল, সমস্ত রাজ্যের বাজারের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে গোটা দেশে একই কর-ব্যবস্থা চালু করা। এক এক রাজ্য এক এক রকম দাবি তুললে, সেই উদ্দেশ্যই সফল হবে না। কিন্তু তার জন্য যে ঐকমত্য প্রয়োজন, তা কোন পথে আসবে, সেটাই এখনও অর্থ মন্ত্রকের কাছে স্পষ্ট নয়। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এমপাওয়ার্ড কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ঐকমত্য তৈরির কাজটি করতেন। বর্তমান চেয়ারম্যান সুশীল মোদী তাঁকে কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অসীমবাবু জানিয়েছেন, দল এ বিষয়ে তাঁকে সবুজ সঙ্কেত জানিয়েছে। তিনিও রাজি। অসীমবাবুকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা এবং মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের কাছে পাঠাতে চান সুশীল মোদী। তিনি তাঁদের রাজি করাতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার। |