৪৭ রানে পড়ল ইংল্যান্ডের ১০ উইকেট
ধোনির উচ্ছ্বাস যেন বিশ্বকাপ জয়ের থেকেও বেশি
দেওয়ালি ধামাকা!
ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ উইকেটটা পড়তেই ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভেসে উঠল। রাত ন’টা বাজতে সাত মিনিট বাকি। দুই ইংরেজ ওপেনারের ব্যাটিংয়ে ৫-০ হোয়াইটওয়াশের আকাশ যে আচমকা সন্ধে থেকে মেঘলা হয়ে উঠেছিল, তখন সে সবের চিহ্ন নেই। আকাশ একদম পরিষ্কার। আধা ভর্তি ইডেনে দেওয়ালি উদযাপন শুরু হয়ে গেল। এর পর উৎসবের রাত পুরোপুরি এসে পড়ল যখন মনোজ তিওয়ারি তুলে নিলেন টিম ব্রেসনানের উইকেট।
প্রবাসে বিধ্বস্ত হওয়ার মধুর প্রতিশোধ সম্পন্ন হওয়া তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। দুপুর থেকে ইডেনে গবেষণা চলছিল, এত কম লোক আর কোনও ওয়ান ডে ম্যাচে এর আগে হয়েছে কি না? সত্যিই রাতের ইডেনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, এ রকম নজিরবিহীন একটা ক্রিকেটীয় কীর্তি। ইংল্যান্ডকে আগের বারেও দেশের মাটিতে ৫-০ হারিয়েছিল ধোনির ভারত। সাত ম্যাচের সিরিজের শেষ দু’টো ম্যাচ ইংল্যান্ড না খেলেই বাড়ি ফিরে যায় ২৬/১১ ঘটার পর। কিন্তু ইডেনে কোনও ভারতীয় ওয়ান ডে টিম হোয়াইটওয়াইশ সম্পন্ন করছে, এমন ছবি তো আগে ওঠেনি। আর সেই ছবি দেখতে ইডেনের এক-তৃতীয়াংশও কি না ভরল না!
অধিনায়কের হেলিকপ্টার শট। ছবি: উৎপল সরকার।
যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অবশ্য অভিনব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকলেন। মোটরবাইকে করে ধোনিদের ভিকট্রি ল্যাপ। হিরো কাপের পর থেকে আর কোনও ভারতীয় এক দিনের দলের সেলিব্রেশন দেখেনি ইডেন। ৫-০ করে ওঠা ধোনি কিন্তু ইডেনকে নিরাশ করেননি। ম্যান অব দ্য সিরিজ তিনি। ম্যান অব দ্য ম্যাচ রবীন্দ্র জাডেজা। ম্যাচে যাঁর ২১ রান এবং বল হাতে চার উইকেট। দু’টো মোটরবাইক এ দিন জিতল টিম ইন্ডিয়া। আর সেই মোটরবাইক নিয়ে ধোনি এবং তাঁর তরুণ ব্রিগেড বেরিয়ে পড়ল ইডেন প্রদক্ষিণে। একটা চালাচ্ছেন ধোনি। অন্যটা বিরাট কোহলি। তার আগে সিরিজের স্মারক হিসেবে অধিনায়ক চেয়ে নিয়েছেন ম্যাচের একটা বল। হোটেলে ফিরে কেক-ও কাটলেন।
বিশ্বকাপ জিতেও যাঁকে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়নি, তিনি এখানে হোয়াইটওয়াশের ট্রফি হাতে অনেক বেশি উচ্ছ্বাস দেখালেন। প্রবাসে দুরমুশ হওয়ার জবাব দিতে পেরে তিনি যে কতটা খুশি, আরও বোঝা গেল যখন মাঠ ঘুরে এসে সোজা মোটরবাইক চালিয়েই উঠে পড়লেন ড্রেসিংরুমের বারান্দায়! সার্কাসে মোটরবাইক শো দেখানোর সময় যেমন ওস্তাদরা করে থাকেন। অবশ্য মোটরবাইক খেল্ যখন, ধোনি কম বড় ওস্তাদ কী!
ইডেন বহু কাল আচ্ছন্ন থাকবে তাঁর ক্রিকেটীয় ওস্তাদি নিয়েও। না হলে ধোনির টিম ৯৫ রানে ম্যাচ জিতে যাওয়ার পরেও ক্রিকেট বিশ্লেষকের ঘোর কাটছিল না। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে টিমটা বিনা উইকেটে ১২৯ ছিল এবং দেখেশুনে মনে হচ্ছিল হোয়াইটওয়াশ আটকে দেবে, তারা মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে এমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল কী করে! মাত্র ৪৭ রানে কী করে হারাল ১০ উইকেট! এই সময়ে ইডেনে খেলা মানে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ শিশির। বিশ্বের আর যে কোনও মাঠে টস হেরে ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা থাকতে পারে। অক্টোবর-নভেম্বরের ইডেনে নেই। সামান্য বুদ্ধিসম্পন্ন অধিনায়ক টস জিতলেই পরে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেবে। জেনেবুঝেই নেবে যে, রাতের দিকে শিশির পড়ে মাঠ এমন ভিজে যাবে, প্রতিপক্ষ বোলাররা বল গ্রিপই করতে পারবে না। ফিল্ডিংয়ে রান গলাবে। এ দিন কুক টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কটা ফিরে আসতে শুরু করল। ইংরেজ ওপেনাররা যখন দিব্যি খেলে যাচ্ছেন, এক সিএবি কর্তা সরেজমিনে দেখতে গেলেন। ফিরে এসে হতাশ গলায় বললেন, “শিশির পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে।” তখন মনে হচ্ছিল, শিশিরে পা পিছলে ৫-০ না হাত ফস্কে যায়!
ইডেনের দর্শকও তখন ক্রিকেট ম্যাচের ভবিতব্য ছেড়ে বিনোদনে মন দিয়েছে। ক্লাব হাউসের আপার টিয়ারে উঠছিলেন সুনীল গাওস্কর। তাঁকে ছেঁকে ধরল সবাই অটোগ্রাফ আর ছবি তোলার জন্য। সানি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে সবাইকে খুশি করে গেলেন। বলে না, সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়! এই ইডেনই এক দিন অপমানজনক ভাবে কলার খোসা ছুড়ে মেরেছিল। পাল্টা জবাব দিতে গাওস্কর শপথ নেন, আর ইডেনে খেলবেন না। ইডেন টেস্ট থেকে নিজেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সরিয়েও নেন। দু’তরফেই আজ কেমন নীরবে সন্ধি হয়ে গিয়েছে! এক অটোগ্রাফ শিকারীকে গাওস্কর বাংলায় বললেন, “পেন কোথায়!” আর যেটা ওই ঠেলাঠেলির মধ্যেও দেখার মতো সেটা হচ্ছে, এক ভক্তের বাড়িয়ে দেওয়া জাতীয় পতাকায় সানির সই দিতে অস্বীকার করা। জিভ কেটে দ্রুত বললেন, “ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ভাই। এর উপর কী করে সই করতে পারি!”
জনতাকে সানির থেকে আবার টিম ইন্ডিয়া-র দিকে ঘোরালেন বরুণ অ্যারন। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পেস সম্ভাবনা ছিটকে দিলেন কুকের স্টাম্প। ঘণ্টায় ১৪১ কিলোমিটার গতিবেগ ছিল বলটার। আর অ্যারনের পেসের চেয়েও দ্রুতগতিতে ম্যাচের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন অধিনায়ক ধোনি। শিশির পড়া তিনি ঠেকাতে পারবেন না। কিন্তু ক্রিকেটীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করে বিলক্ষণ প্রকৃতিকে হারানোর বিক্রম দেখাতে পারেন। মঙ্গলবারের ইডেনে প্রথমে সেটা করলেন ব্যাটসম্যান ধোনি। আঠাশতম ওভারে ভারত তখন ১২৩-৪। ভাল খেলতে খেলতেও আউট হয়ে গেলেন মনোজ তিওয়ারি। ওই সময় দক্ষ নাবিক দরকার। ধোনি দেখালেন কেন তাঁকে মাইকেল বিভানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। ৫০ করলেন ৬২ বলে। আর শেষের ২৫ রান এল মাত্র ৭ বলে। চারটে বিশাল ছক্কায় ইডেন মাতিয়ে ৬৯ বলে ৭৫ নট আউট। কিন্তু ব্যাটসম্যান ধোনি নন, মঙ্গলবারের ইডেনে আসল ওস্তাদ অধিনায়ক ধোনি। যিনি ইংরেজ ওপেনাররা ছন্দে আছে দেখে দ্বিতীয় পাওয়ার প্লে ধরে রাখলেন। ওত পেতে থাকলেন কখন ওদের একটা উইকেট পড়বে আর তখনই পাওয়ার প্লে-টা নিয়ে স্পিনার লেলিয়ে ওদের প্রলুব্ধ করে মারব। একুশতম ওভারে কুককে ফেরালেন অ্যারন। আর বাইশতম ওভারেই পাওয়ার প্লে নিয়ে নিলেন ধোনি। পরের পাঁচ ওভারে মাত্র দশ রান দিয়ে চার উইকেট তুলে নিলেন তাঁর স্পিনাররা। ক্রিকেট-চাণক্যের চালে পাওয়ার প্লে-র আগুনেই পুড়ে ছাই ইংল্যান্ড।
সতীর্থদের সঙ্গে মোটরবাইকে ঘুরে ইংরেজ-বধের ছাইভস্ম এর পর সারা ইডেনে ছড়িয়ে দিলেন ধোনি। তারও খানিক্ষণ পরে ফাঁকা ইডেনে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় মঞ্জরেকর বলছিলেন, “এখন দু’টো বল ব্যবহার করা হচ্ছে বলে হয়তো শিশিরের প্রভাব কিছুটা কমেছে। তবে আমার মনে হয় ইংল্যান্ড স্রেফ কেঁপে গিয়ে হারল।” মঞ্জরেকর এর পর আরও গভীর পর্যবেক্ষণ পেশ করলেন, “এই মানসিকতা নিয়ে ইংল্যান্ড কত দিন টেস্টেও এক নম্বর থাকতে পারবে আমার সন্দেহ আছে!”
কী দাঁড়াল? না, প্রবাসে যারা মুকুট কেড়ে নিয়েছিল, দেড় মাসের মধ্যে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল! মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জন্য এর চেয়ে ভাল দেওয়ালি-উপহার আর কী হতে পারে!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.