শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবার দ্বীপরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু তামিল- সমস্যার সহজতম সমাধানটা মনে হয় করে ফেলেছেন। এথনিক ক্লেনজিং। আস্তে-আস্তে তামিলদের নিঃশেষ করে দাও। এল টি টি ই-র তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানটা উপলক্ষ ছিল। প্রথম থেকেই ওই অভিযানে অসামরিক, নিরস্ত্র তামিল জনসাধারণের উপর মর্টার, ট্যাংক, ভারী কামানের গোলা এবং বোমারুর হামলা চলেছে। কিন্তু সেই আক্রমণটা একটা ছোট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাই অবশিষ্ট বিশ্বের নজরে পড়েনি। তখন কেউ রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর অভিযোগও তোলেনি। এখন নানা মহলেই তোলা হচ্ছে। এমনকী শ্রীলঙ্কাকে কমনওয়েল্থ রাষ্ট্র গোষ্ঠী থেকে বহিষ্কার করার দাবিও দানা বাঁধছে। আগামী মাসে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে একটা হেস্তনেস্ত হতে চলেছে।
লাখে-লাখে নিরীহ তামিল নিহত। এল টি টি ই-কে বাধ্য হয়ে সহ্য করা যদি তাদের অপরাধ হয়ে থাকে, গেরিলাদের সশস্ত্র হুমকি উপেক্ষা করে সরকারের আশ্রয়-শিবিরে পালিয়ে না-আসার নিরুপায়তা যদি তাদের হত্যা করার কারণ হয়ে থাকে, তবে গেরিলাদের সঙ্গে রাজাপক্ষের সেনাদের কোনও তফাত থাকে না। শুধু গেরিলারা তামিল মহিলাদের গণধর্ষণ করত না, রাজাপক্ষের দেশপ্রেমিক সৈন্যরা পাইকারি হারে তামিল মহিলাদের শিবির থেকে তুলে নিয়ে যেত। তবে এ সব পরের ঘটনা। |
তার অনেক আগে থেকেই এল টি টি ই-র বিরুদ্ধে অভিযানকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক অভিযান’-এর অংশ হিসাবে তুলে ধরার কুশলী চেষ্টা চলে। অন্য দিকে দেশের ভিতরে উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদ প্রচার। অতঃপর রাজাপক্ষের প্রচারমাধ্যম যুদ্ধের দামামা বাজায়। নিজেদের পরিহার্য বাড়াবাড়ি ও নিবার্য হিংসাকে গেরিলাদের ঘাড়ে চাপিয়ে রাজাপক্ষে তামিল নির্মূলকরণের যুক্তি সাজান। সত্যতা যাচাইয়ের উপায় ছিল না। গোটা গৃহযুদ্ধ-পর্বে সব বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, এখনও আছে। দু-একটি বেসরকারি মিডিয়ার সাহসী সাংবাদিককে গুপ্তহত্যায় সরিয়ে অবশিষ্ট মিডিয়াকে সরকারি ভাষ্যের প্রতিধ্বনি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ, রেড ক্রস, মানবাধিকার কমিশন, কারও প্রতিনিধিদের অকুস্থলে যেতে দেওয়া হয়নি। সিংহলি নাগরিক সমাজ রাজাপক্ষের অনুগামী চিন্তন-পুলিশে পরিণত। তামিলদের দুর্গতির প্রতি বিশ্ব তাই নিদ্রামগ্ন থাকতে পেরেছে।
কিন্তু রাজাপক্ষেরা তামিল-বিরোধী সমরাভিযানকে ‘জিরো সিভিলিয়ান ক্যাজুয়াল্টি’র মানবিক অভিযান বলে চালাবার চেষ্টা করলেও রাষ্ট্রপুঞ্জ যুদ্ধের অন্তিম পর্বে সিংহলি সেনার আক্রমণে শুধু উত্তরের ভান্নি অঞ্চলেই ৪০ হাজার অসামরিক তামিল নারীশিশুবৃদ্ধ ও যুবকের নৃশংস হত্যার অভিযোগ এনেছে। মান্নারের বিশপ রাজাপক্ষে সরকারের কাছে গৃহযুদ্ধে ‘নিখোঁজ’ ১ লক্ষ ৪৬ হাজার তামিলের হদিশ চেয়েছেন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকে কুমারতুঙ্গা জানিয়েছেন, এই শ্রীলঙ্কাকে স্বদেশ ভাবতে তাঁর লজ্জা হয়। ভান্নিতে অন্তত তিন হাজার বার সিংহলি বায়ুসেনা বোমা ফেলেছে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস চিহ্নিত হাসপাতালে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, খাবারের গুদামে। গেরিলাদের অবরোধ থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানো তামিল গ্রামবাসীদের মর্টারের গোলায় মুড়িয়ে দিয়েছে। এ সবের ছবি রয়েছে-- স্থিরচিত্র এবং ভিডিয়ো। গত দু’বছর ধরে সিংহলি বর্বরতা ও পৈশাচিকতার সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো তিল-তিল করে সংগৃহীত হয়েছে। এখন সে সব বিশ্বের সামনে আসছে। শাসকরা ওই সব সাক্ষ্যপ্রমাণকে মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক বলে চিৎকার করছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং ব্রিটেনও প্রমাণ উপেক্ষা করতে পারছে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী চিন অবশ্য রাজাপক্ষেদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদ-সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলিতে চিনই তামিল-নিধন পর্বে শ্রীলঙ্কাকে তিরস্কৃত হতে দেয়নি। তামিল হত্যার মারণাস্ত্র এবং তা ব্যবহারের প্রশিক্ষণ রাজাপক্ষের ঘাতকরা এই গণপ্রজাতন্ত্রের কাছ থেকেই পেয়েছে। ভারত মহাসাগরে রণনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করতে রাজাপক্ষের জন্মস্থান হাম্বানটোটায় বন্দরনগরী নির্মাণ দিয়ে যে বেজিং-কলম্বো অক্ষের সূচনা, দ্বীপরাষ্ট্রের তামিলদের নিঃশেষ করার অভিযানে সর্বতো সাহায্যেই তার পরিণতি।
তামিলরা ভারতেই চলে এসেছেন লক্ষাধিক। গিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, কানাডা, ইংল্যান্ডে। সিংহলি জাত্যভিমানের সঙ্গে সহিংস বৌদ্ধ উগ্রপন্থা এবং ট্রট্স্কিপন্থী বামেদের নিবিড় সংহতির ফলে এবং এল টি টি ই-র সার্বিক পরাজয়ের পর তামিলদের বাঁচার পরিসর আর দ্বীপরাষ্ট্রে নেই। তদুপরি দ্বীপের প্রথাগত তামিলভূমিতেও রাজাপক্ষের পুরাতাত্ত্বিকরা আস্ত বৌদ্ধ স্তূপ ও গোটা-গোটা বুদ্ধমূর্তি খুঁজে পাচ্ছেন। প্রভাকরণ-হত্যার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের ধর্মপত্নী জাফনার তামিলভূমির হৃৎপিণ্ডে উদ্বোধন করেছেন সিংহলি বৌদ্ধ ধর্মের আদি জননী সম্রাট অশোকের কন্যা সঙ্ঘমিত্রার বিশাল মর্মরমূর্তি। ‘নাইন্টিন এইট্টি ফোর’-এর অরওয়েলীয় আখ্যান মেনেই যেন চলছে সিংহলি ইতিহাসের পুনর্লিখন।
তামিলরা কে কোথায় পুনর্বাসন পাবেন, রাজাপক্ষ সরকার তা ঠিক করছে, ফাঁকে-ফাঁকে সিংহলিদের বসত করিয়ে। সিংহলি সেনাদের জন্য সেখানে স্থায়ী ছাউনি গড়ার কাজও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের প্যালেস্তাইনি ভূমিতে ইহুদি বসত করিয়ে তাদের উপর স্থায়ী নজরদারির পাকা বন্দোবস্তের অনুরূপ। জাফনা-কিলিনোচ্চির জন্মভূমিও তামিল নবজাতকদের কাছে প্রবাস হতে চলল।
কথা ছিল সংখ্যালঘু তামিলদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার। চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা যখন প্রেসিডেন্ট, সে-কথা এগোয়ও। তামিল-অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্বের প্রদেশগুলিকে ভৌগোলিক ভাবে সংযুক্ত করে সেখানে তামিল স্বশাসন সুরক্ষিত করাই ছিল এল টি টি ই-র ‘ইলম’-এর বাস্তবসম্মত বিকল্প। রাজাপক্ষেরা, লক্ষ করুন, ভুলেও তামিল স্বশাসন বা শ্রীলঙ্কার শাসনপ্রণালীতে তামিলদের অংশিদারিত্বের বিষয়টি তুলছেনই না। এমনকী সিংহলি জাতিগৌরবের যে কাঠামোটির মধ্যে তামিলদের জায়গা দেওয়ার অনুগ্রহ দেখানো হচ্ছে, তাতেও তামিলদের প্রতি আইনগত ও সাংবিধানিক বৈষম্য দূর করার সাড়াশব্দ নেই। এমন একটি শ্রীলঙ্কায় তামিলরা কেন চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবেন? অতএব তাঁরা শ্রীলঙ্কা ছাড়ছেন। থাকবেন যাঁরা, তাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির অভাবে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাবেন। শ্রীলঙ্কার ইতিহাস থেকে রাজাপক্ষেরা মুছে দেবেন তামিল জাতির আখ্যান।
তথ্যসূত্র: দ্য কেজ, গর্ডন ওয়েস। বডলি হেড, লন্ডন |