|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
বেসরকারি চিকিৎসার উপরেও নজর রাখুক সরকার |
শুধু সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কড়াকড়িতে কাজ হবে না। আর, জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করে
শুধু বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ঝকঝকে করলে অবস্থা পাল্টানোর আশা ক্ষীণ।
অরিজিতা দত্ত |
বেশ কিছু দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যসূচক এবং স্বাস্থ্য দফতরের কাজকর্ম নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নানা বিতর্ক। বাস্তবে কিন্তু ‘মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল’-এর প্রধান দু’টি সূচক শিশুমৃত্যুর হার এবং মাতৃমৃত্যুর হার উভয় অনুযায়ীই পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে চতুর্থ এবং মোট মৃত্যুহার অনুযায়ী স্থান সবার উপরে (এস আর এস ২০০৯)। এই সাফল্য অবশ্য অন্যান্য পরিচিত স্বাস্থ্যসূচকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। কুড়িটি বড় রাজ্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে প্রসবের হার ও পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত শিশুর হারে এ রাজ্যের স্থান যথাক্রমে একাদশ ও পঞ্চদশ (ইউনিসেফের ২০০৯-এর সমীক্ষা অনুযায়ী)। এই সমীক্ষা আরও জানায়, প্রসবের মাত্র ৬৬ শতাংশ মা আলাদা শয্যা পান, যা ভারতের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে ন্যূনতম। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত গ্রামীণ জায়গাগুলিতে সার্বিক পরিকাঠামো, স্বাস্থ্যকর্মী (মূলত ডাক্তার) এবং সর্বোপরি উপস্থিত পরিকাঠামোর সুব্যবহারের প্রচুর অভাব। জেলা ও মহকুমাগুলির হাসপাতালেও একই চিত্র। ফলে যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা রোগী নিয়ে চলে আসে কলকাতা বা জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে রেফারেল সিস্টেমের তোয়াক্কা না করেই। তার জেরে মেডিক্যাল কলেজগুলির নাভিশ্বাস উঠছে!
|
অসুখ কোথায়? |
প্রথমত, ১৯৯৩ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট রিপোর্টে পরিষ্কার বলা ছিল যে, গর্ভবতী মায়ের সেবা, শিশুজন্ম, টীকাকরণ, যক্ষ্মার চিকিৎসা এবং এইচ আই ভি রোগের চিকিৎসা ছাড়া সরকার বিনামূল্যে কোনও স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবে না। এই পরিষেবাগুলি হল ‘এসেনশিয়াল ক্লিনিক্যাল প্যাকেজ’। এই রিপোর্টটির ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কালে অন্যান্য দেশগুলির মতো ভারতও নতুন স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণ করে। তাই রাষ্ট্রীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের মতো বৃহৎ একটি সরকারি নীতি শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসার কিছু অংশের ওপর গুরুত্ব দেয় সরকারি হাসপাতালে অন্যান্য ‘কিউরেটিভ’ চিকিৎসার কথা প্রায় বিস্মৃত হয়ে। এই সময়েই আবার এমন কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বাড়ে যা সংক্রামক নয়, অথচ পরিবেশ ও জীবনযাত্রার মানের ওপর নির্ভর করে (যেমন, হৃদ্রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, মানসিক রোগ, চোখের অসুখ ইত্যাদি)। অথচ জেলা স্তরের হাসপাতালে এই সব রোগের চিকিৎসা হয় না। একমাত্র ভরসা মেডিক্যাল কলেজগুলি। |
|
বেহাল। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ছবি: সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় |
দ্বিতীয়ত, জনস্বাস্থ্যে যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, রাজ্য সরকারগুলি তা দেয় না। তাই কেরলের স্বাস্থ্যসূচক ভাল হলেও ম্যালেরিয়া, কলেরা, চিকনগুনিয়া রোগে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গেও জনস্বাস্থ্যে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৭ শতাংশ খরচ হয় এবং তা গত দশ বছরে নিম্নগামী।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে কোথাও জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি শয্যা (কল্যাণী মহকুমা), কোথাও একেবারেই অপ্রতুল (চাঁচল মহকুমা)। মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতেও পিছিয়ে পড়া এলাকাতেও দ্বিস্তর হাসপাতালের পরিষেবা যথেষ্ট নয় (যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমা), আবার কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ, দু’টি জেলা হাসপাতাল (বারাসত ও বাঙ্গুর), একটি মহকুমা হাসপাতাল (বিধাননগর) এবং একগুচ্ছ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল।
চতুর্থত, গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে প্রকৃত প্রয়োজনের মাত্র ২৩ শতাংশ ডাক্তার আছেন, তাঁরাও কাজ করেন সপ্তাহে কয়েকটি দিন, কয়েক ঘণ্টা। নিজে দেখেছি, বাঁকুড়ার উপজাতি অধ্যুষিত চিনাবাড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক নবীন ডাক্তার বহির্বিভাগে বসতেন বেলা দশটা থেকে একটা। আমার সামনে গ্রামবাসী ও পঞ্চায়েত প্রধান তাঁকে আরও একটু থাকতে অনুরোধ করলে তিনি হুমকি দেন ‘মেডিক্যাল কাউন্সিলে জানাব’! কেরলের মতো স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে দিলে বোধহয় কিছু সমাধান সম্ভব।
এখানে দু’টি জিনিস উল্লেখ্য। এক, এই রাজ্যে যাঁরা ডাক্তারি পড়েন, তাঁদের অধিকাংশই উচ্চ মধ্যবিত্ত। পাশ করার পর প্রত্যন্ত গ্রামে পাঠানো হলে তাঁরা মানিয়ে নিতে পারেন না। তাঁদের স্বপ্ন থাকে বেসরকারি সংস্থায় বা নিজে স্বাধীন ভাবে প্র্যাকটিস করার। দুই, এ দেশে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সমান্তরালে একটি ততটাই বড় অনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আছে, যেখানে ডাক্তার, আয়া, বিভিন্ন পরীক্ষা সব কিছুরই মূল্য লাগামছাড়া। এক সরকারি নবীন ডাক্তার প্রত্যন্ত গ্রামে কষ্ট করে থেকে পাবেন মাসিক ৩০,০০০ টাকা। তাঁরই বন্ধু কলকাতায় প্র্যাকটিস করে পাবেন ৭০,০০০ টাকা। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পরের অপশনটি চাইবেন সরকারি কাজ করতে করতেই এবং কাজও পাবেন, কারণ ডাক্তার আমাদের দেশে দুর্মূল্য বস্তু। এই গল্প পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্যে কমবেশি আছে। অবস্থা সামাল দিতে কী করণীয়, সেই প্রসঙ্গে আসছি, কিন্তু তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গ।
|
তফাত কোথায়? |
আমার প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গে শুধু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় তোলা হয় কেন? কোন যুক্তিতে বিখ্যাত বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে চার জনের কেবিনে না থেকে একক কেবিনে থাকলে বেড়ে যায় শুধু শয্যা-ভাড়াই নয়, একই অস্ত্রোপচারের জন্য বুক করা ওটি ভাড়া, আয়ার খরচ, খাবার খরচ, এমনকী ডাক্তারের ভিজিট-ও? কী এমন ‘গুণগত’ তফাত যার জন্য একই পরীক্ষামূল্য কোথাও ৩০০ টাকা, কোথাও ১৫০০? কেন ওষুধের মতো পরীক্ষামূল্যও বেঁধে দেওয়া যায় না?
যে বেসরকারি হাসপাতালগুলি সরকারি অনুদানে সস্তায় জমি পায় বা যন্ত্র আমদানির ওপর শুল্ক ছাড় পায়, তারা শর্ত মোতাবেক কিছু দরিদ্র রোগীর সেবা বিনামূল্যে করছে কি না, তা কি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়?
আমরা হামেশাই মুক্ত বাজারের জন্য সওয়াল করতে আমেরিকার নাম নিই। সেখানে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে কত বেশি পারিশ্রমিক পান! কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, সেখানে ডাক্তারের পারিশ্রমিকের মধ্যে নিহিত থাকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা কনজিউমার কোর্টের যাবতীয় খরচ। এ রাজ্যের আমজনতা একটি ব্যতিক্রমী কেস বাদ দিলে কোনও ঘটনা কি মনে করতে পারেন যে তাঁরা কোনও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছেন? যেখানে নালিশ জানানো যায়, এই মুহূর্তে সেখানেই কোনও আধিকারিক নেই!
তাই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি পরিবর্তনের অনুরোধ করছি:
এক, কেরল মডেলে আইন প্রণয়ন করে স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি পঞ্চায়েতের হাতে দেওয়া হোক।
দুই, জেলায় ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগের চিকিৎসার বন্দোবস্ত হোক।
তিন, ডাক্তারি প্রবেশিকায় নিম্নবিত্তের জন্য সংরক্ষণের বন্দোবস্ত।
চার, স্নাতকোত্তর প্রবেশিকায় গ্রামে কাজ করা ডাক্তারদের জন্য সংরক্ষণ।
পাঁচ, জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দূরবর্তী সাময়িক পরিষেবা বা ‘আউট রিচ ক্যাম্প’-এর ব্যবস্থা করা।
ছয়, প্রাইভেট প্র্যাকটিস, বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নিয়মানুবর্তিতা চালু করা। শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানে কড়াকড়ি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনিয়ন্ত্রিত রেখে দিলে কোথাও পরিষেবা ঠিক মতো পাওয়া যাবে না।
সাত, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট তথ্যাবলি সংগ্রহ।
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক |
|
|
|
|
|