|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
ত্রিনয়ন, জিভ, ভয় |
স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকে বেভুল পথিক। কালীপুজোয়, আলো ও ধ্বনির সঙ্গে জেগে ওঠে বেদনা। পুরনো বেদনা।
শোভন তরফদার |
কালীর কথা উঠলেই কেন যে ছবি বিশ্বাসের কথা মনে পড়ে! বা, একটা ছবির কথা মনে পড়ে। সেই ছবির একটা স্বপ্ন। স্বপ্নে অন্ধকার। নিকষ কালো। সেই আঁধারের পটে ফুটে উঠছে একটি একটি করে তিনটি চক্ষু। ত্রিনয়ন। কোন ছবি, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই, ফিল্ম-রসিকেরা জানেন, কিন্তু ওই তিনটি চক্ষু, নিশ্চিত, আমার মতো অনেকেরই মর্মে আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে। কালী বললেই সেই কালোর মধ্যে জেগে ওঠা তিনটি চোখ। সেই চক্ষু স্বস্তি দেয়? না, ভয় জাগায়?
জানি না। চোখের ভাষা, ছবির ভাষা যে যাঁর মতো করে পাঠ করবেন ঠিক, কিন্তু কালী বললেই সর্বপ্রথম মনের পটে ওই তিনটি আকার, কালোর গায়ে সাদা। অতঃপর, ‘দেবী’ ছবিতে কী হয়েছিল, আমরা জানি। মাঝে মধ্যে ভাবতে ইচ্ছে করে, ছবি তো হল, কিন্তু যে ভাবে ওই ছবিটির নাম লিখলেন সত্যজিৎ, সেই আশ্চর্য নামাঙ্কনটি কী ভাবে দেখা দিল ছবির একেবারে নির্যাসটুকু নিয়ে। এই নামাঙ্কন একটিমাত্র শব্দ ‘দেবী’ নিশ্চিত ভাবেই, তাঁর অবিস্মরণীয় লেটারিং-গুলির অন্যতম। কারণ, এর মধ্যে একই সঙ্গে অপার্থিব মহিমা, যেন দৈবী ঐশ্বর্য, পাশাপাশি ভয়াল সব বক্ররেখা। খড়্গের মতো। ছবি আঁকার পশ্চিমি প্রেক্ষিত, অর্থাৎ ওয়েস্টার্ন পার্সপেক্টিভ নিপুণ ভাবে এসেছে এই নামাঙ্কনের গায়ে, যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে দৈবী প্রভা! নাকি, আমরাই ক্রমে ঢুকে যাচ্ছি তার মধ্যে!
ভয় করে। অন্ধকারে জেগে ওঠা ওই তিনটি চক্ষু দেখলে দেবীর মহিমার সঙ্গে ঘনিয়ে ওঠে আতঙ্ক। দেবীর চোখ আমাদের কী বলে? মাথার মধ্যে হু হু করে বাতাস দেয়, সামনে থেকে নির্বিবাদে মুছে যায় মেট্রোপলিস। কলকাতা কই, এ তো বিপুল বালি, ঝাউবন, সমুদ্রের মোহানা আর আমি একা বসে আছি, বেভুল পথিক। আমাকে ডাকবে কে? কোনও অপরূপা? নাকি, ত্রিনয়ন। ওই ত্রিনয়ন। |
|
মাতৃ-রূপা। সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ছবির একটি দৃশ্য। |
মাঝে মাঝে যখন একেবারে একলা থাকি, কোথাও যেন ফিরে আসে ছোটবেলার নানা রকম ভয়। সেই সব ভয়, যা এখন আর পাই না, কিন্তু পেতে ইচ্ছে করে, মাঝে মাঝে। সেই কথাটা, আশ্চর্য ভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেন এক কবি। রণজিৎ দাশ। তাঁর একটি কবিতা শুরু হয় এ ভাবে:
পুরনো বেদনা ভুলে যাওয়াও আরেক বেদনা।
শুকিয়ে-যাওয়া ক্ষতের মতো, চাপ দিলে আর ব্যথা লাগে না।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কই, চিতায় শোয়ানো সেই আলতা-পরা পা দু’টির কথা মনে পড়লে আর চোখে জল আসছে না তো?
তা হলে কি, এত দিন পর সত্যিই ভুলে গেলাম তাকে?...
এর পর এগোতে এগোতে কবিতাটি শেষ হয় এই চরণে: এই দ্বিতীয় বেদনার আতঙ্কে মানুষ তার প্রথম বেদনাটিকে মায়ের স্মৃতির মতো আঁকড়ে ধরে থাকে।
ছোট থেকে বড় হওয়ার নতুন বিষ, পুরনো বিষ পার হয়ে প্রতি বছর কালীপুজো স্পর্শ করে আমার একটি পুরনো বেদনা জেগে ওঠে। ছেলেবেলায় যে সব ভয়ের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ঘুমে তলিয়ে যেতাম, অথচ ঘুমেও পিছু ছাড়ত না তারা, ফিরে আসত অনিবার্য, সেই সব ভয়। এই ঝকঝকে একুশ শতকে সেই আতঙ্কের দল কম্পিউটার গেম-এ ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে নিজেরাই। তাই মেয়েকে সে সব কাহন বলতে গিয়েও থমকাই। মনে টান পড়ে তবু। মায়ের স্মৃতির মতো আকুল, কিন্তু লুকিয়ে আঁকড়ে থাকা যাদের, তারাই যখন ফিরে আসে, মনে হয়, পুরনো ভয় ভুলে যাওয়াও আর এক ভয়...
তার চেয়ে বরং, যখন গভীর রাত্তিরে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যাবে, রাতকানা চাঁদ হবে আধখানা ভাঙা, তখন মনের কুঠুরি থেকে গুপ্তধনের মতো বের করে আনব দু-একখানা ভয়। যে সব ভয়ের গায়ে আমার ছেলেবেলার টুকরো টাকরা জড়ানো।
সেই সূত্রেই যদি মনে পড়ে যায়, তাকে! সেই যে দুটো হাত আসল, আর বাকি দুটো সাজানো, কিন্তু সেই আসল-নকল ভেদবুদ্ধি তখনও হয়নি, ফলে বরানগর বাজারে হঠাৎ আমার সামনে ওই তো চারটে হাত, নীলচে গা, আর গলায় ঝুলছে ও সব কী, কাটা মুণ্ডুর দল, হাতে খড়্গ, আর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে জিভ। লোলজিহ্বা!
সেই যে একবার বহুরূপীটিকে দেখে চক্ষু বুজে ফেলেছিলাম, সেই চোখ খুলল যখন, তদ্দিনে আমি ঢের বড় হয়ে গিয়েছি। অথচ, তার পর থেকে মাঝে মাঝেই, কেন জানি না মনে হয়, আমি হাঁটছি, একলা, পা টিপে টিপে। চারিদিকে কেউ কোত্থাও নেই, অথচ মনে হচ্ছে, কী জানি আমাকে যেন অনুসরণ করছে কেউ। পিছনে কারও যেন একটা পা। পায়ের শব্দ। অথচ, এখানে কী করে লোক আসে। এখানে কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার পিছু নেবেই বা কী করে? এ তো বিশাল রানওয়ে। ধূ ধূ করছে। মনকে সান্ত্বনা দিই, তবু ভয় যায় না। তার পর সমস্ত সাহস জড়ো করে হঠাৎ পিছনে ফেরা, আর তখনই, আমার সামনে বিরাট একটি জিভ। আর, কৃষ্ণ-কালো আনন।
ছাঁৎ করে-ওঠা বুকে আচমকা দেখতে পাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কে এক ভদ্রলোক। হা হা করে হাসছেন। চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেন!
চেনাই তো। ঋত্বিককুমার ঘটক।
কালী মানে কিছু ধ্বনি। ধ্বনির কোনও ছবি হয়? আমরা যে যার মতো করে জানি, হয়।
যেমন, একটি সুবিশাল কালীমূর্তি এবং একটি গান। কে গেয়েছিলেন, ভাল মনে নেই। হয়তো, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, বা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য! ছোটবেলায় একবার বাড়ির কাছেই কোনও এক পুজো প্যান্ডেলে গিয়েছি, সেখানে বিরাট কালীপ্রতিমা, দশ-বারো হাত তো হবেই, সেই বিপুল শরীর, মুণ্ডমালা আর ফুলে ঢাকা, প্যান্ডেলের বাইরে মাইকে বাজছে গান, বসন পরো মা, পরো মা গো, বসন পরো মা!...! শোনামাত্র মস্তিষ্কের ভিতরে কোথাও একটি বিস্ফোরণ হয়েছিল। কেমন সেই মাতৃরূপ যার উদ্দেশে উঠে আসে এই আর্তি? বসন পরো, মা...
যেমন, রণো গুহঠাকুরতা। তখন এত চ্যানেল বিস্ফোরণ হয়নি, টেলিভিশন বলতে ছিল ওই দূরদর্শন, তাতেই শুনেছিলাম বোধহয়, রণো গাইছেন, মা, আমি তোর কী করেছি...! কী ভাবে সুরের মায়া তৈরি হচ্ছে সমস্ত পরিবেশে, সেই সুর টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতলের দিকে, কী ভাবে, হ্যাঁ স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার চোখের কোণটা জ্বালা করছে, কান্না এল না কি...
যেমন, সাগর সেন। থাকতাম মৃণাল পার্কে, চিলতেখানেক ফ্ল্যাট, বছরের তিনশো চৌষট্টিটি দিন সমস্ত পাড়া ধূসর, কালীপুজোর রাতটায় শুধু জানলায় জানলায় আলো। মোমবাতি। তেমনই এক কালীপুজোর সন্ধ্যেয় একা একাই হাঁটছি, তখন আমি কিশোর, ফলে তখন একটু করে আমাকে ছোঁয় হেমন্তের বিষাদ। একটি বাড়ি, তার একতলায় থাকত একটি পরিবার। তাদেরও জানলায় মোম আর তাতে অগ্নিসংযোগের পালা চলছে। আগুন ছোঁয়াচ্ছে এক মেয়ে, আমার চেয়ে একটু ছোট। একটি বার আমার চোখে চোখ পড়ল তার। আগেও পড়েছে, কিন্তু সে দিন, কী জানি কোন যোগাযোগে পাড়ার পুজোর মাইকে হঠাৎ সাগর সেন। বঁধূ কোন আলো লাগল চোখে...
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, অপলক। তার পর, চলে গেল ভিতরে। আর আসেনি।
জানলার সেই সাঁঝবাতি আজও আমার কাছে রূপকথা! প্রথম বেদনার মতো।
ঋণ: দ্বিতীয় বেদনা, রণজিৎ দাশ (ঈশ্বরের চোখ, আনন্দ) |
|
|
|
|
|