হাতে বোমা-তরোয়াল-লাঠি-ইট। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। লক্ষ্য, পুলিশ।
অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রায় হাজারখানেক মানুষের সেই ভিড়। খাস পুলিশ-থানার উপরে! প্রতিরোধ উড়ে গেল খড়কুটোর মতো। যথেচ্ছ বোমাবাজি আর প্রহারে ওসি-সহ পাঁচ পুলিশকর্মী গুরুতর জখম হলেন। এখানেই শেষ নয়। দুর্বৃত্তেরা থানার লাগোয়া পুলিশকর্মীদের আবাসনে গিয়েও চড়াও হয়। নির্বিচারে হেনস্থা করে মহিলাদের। শিশুদেরও রেয়াত করা হয়নি বলে অভিযোগ।
আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রশাসনকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে বলছেন, তখন আইনের রক্ষকেরাই আক্রান্ত হলেন এ ভাবে! সোমবার সকালে, কলকাতার ৮৫ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপিতে। যেখানে গত বছরই রথের মেলা উপলক্ষে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছিল। হটুগঞ্জের সেই কাণ্ডের পরে গোসাবার ছোট মোল্লাখালির কোস্টাল থানা থেকেও আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিনের হামলাও ধৃত কিছু দুষ্কৃতীকে ছাড়িয়ে আনার উদ্দেশ্যেই চালানো হয়েছে বলে জেলার পুলিশ-কর্তাদের প্রাথমিক অনুমান। সে চেষ্টা সফল হয়নি বটে, কিন্তু ইট-লাঠি-তরোয়ালধারী হাজারো মানুষের ঘণ্টাখানেকের তাণ্ডবে ও বোমাবাজিতে গোটা থানা চত্বর কার্যত ধ্বংসস্তূপের চেহারা নেয়। শেষমেশ জেলা সদর আলিপুর থেকে বিশাল বাহিনী গিয়ে লাঠি চালিয়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। স্থানীয় মানুষের দাবি, পুলিশ শূন্যে তিন রাউন্ড গুলিও চালিয়েছে, যদিও পুলিশ তা স্বীকার করেনি।
ঘটনার সূত্রপাত কী ভাবে?
পুলিশ-সূত্রের খবর: কুলপি থানা এলাকায় মাস তিনেক যাবৎ অপরাধমূলক কাজকর্ম বেড়ে গিয়েছে। পুলিশি ধরপাকড়ও চলছে। রবিবার ভোরে গোমুখবেড়িয়ায় তিন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মারমুখী জনতার হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ হাসপাতালে পাঠায়। অন্য দিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এ দিন থানায় সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন ওসি। আর সেই বৈঠক শুরুর আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্ত জনতা। |
যে ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পুলিশ-কর্তারা বলছেন, গোমুখবেড়িয়ায় ধৃতদের ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে, এবং ধরপাকড় থামানোর জন্য পুলিশকে ‘শিক্ষা’ দিতেই এই পরিকল্পিত আক্রমণ। কর্তাদের মতে, হামলাকারীদের জানা ছিল না যে, ধৃত ৩ দুষ্কৃতী রয়েছে হাসপাতালে। তারা কুলপি থানায় পুলিশের হেফাজতে রয়েছে ধরে নিয়েই জনতার রোষ গিয়ে পড়ে থানার উপরে।
এবং সেই ‘রোষের’ ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে যায় নিরাপত্তা। সকাল তখন পৌনে ন’টা। বিশাল সশস্ত্র জনতা থানায় ঢুকে দরজা-জানলা-আসবাব-কম্পিউটার ভেঙে তছনছ করে। বেধড়ক মারধর করা হয় ওসি গৌতম চক্রবর্তীকে। তিনি ছাড়া কুলপি থানায় ছ’জন এসআই, ৯ জন এএসআই এবং ২২ জন কনস্টেবল রয়েছেন। কেউ সে ভাবে বাধা দিতে পারেননি। থানার ভিতরে বোমা ফাটানো হয়। স্প্লিন্টারের আঘাতে চার পুলিশকর্মী জখম হন, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মোটরবাইক-সহ থানার অন্তত কুড়িটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, এমনকী থানায় আগুন ধরানোরও চেষ্টা হয়। তবে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো একটা ঘরে তালা দেওয়া ছিল বলে লুঠ হয়নি।
এ দিকে একটি দল যখন থানায় তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন আর একটা দল চড়াও হয় থানার পিছনে পুলিশকর্মীদের দোতলা আবাসনে। সেখানে প্রায় কুড়িটি পরিবারের বাস। অভিযোগ, প্রতিটা ঘরে ঢুকে মহিলাদের নির্বিচারে মারধর করা হয়েছে। ওসি-র স্ত্রী পালিয়ে গেলেও বাকিরা পারেননি। এক পরিবারের পরিচারিকা মমতা খানের কথায়, “আমি কলে জল ভরছিলাম। কয়েক জন তরোয়াল নিয়ে দৌড়ে এল। আমি বালতি ফেলে ছুটে ঘরে ঢুকতে গেলে আমাকে হেনস্থা করল।” তিনি আরও জানাচ্ছেন, “টিউবওয়েলটাও ওরা গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে! বাচ্চাদের তুলে আছাড় মারতে যাচ্ছিল!” |
জখম পুলিশকর্মী সমীর মোদক।—নিজস্ব চিত্র |
গোলমাল শুধু ওই চত্বরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কেও। হামলাকারীদের একাংশ রাস্তা অবরোধ করে। গাড়ি ভাঙচুর হয়। আলিপুর থেকে পুলিশ নিয়ে কয়েকটা গাড়ি কুলপি আসার পথে সেই অবরোধে পড়ে। অভিযোগ, কচুবেড়িয়ার কাছে একটি পুলিশের গাড়ির চালক সমীর মোদককে নামিয়ে মারধর করা হয়। পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমাও ছোটে। বেলা প্রায় বারোটা পর্যন্ত অবরোধ চলে।
কারা চালাল এমন হামলা?
তদন্তকারী অফিসারেরা জানাচ্ছেন, মূলত, রামনগর ও গাজিপুরের বহু বাসিন্দা এতে জড়িত। এ দিনই পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়েছে।
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এ দিন বিকেলে কুলপিতে আসেন আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত, পুলিশ সুপার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা, জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগম এবং
জেলা সভাধিপতি শামিমা শেখ। তাঁরা বৈঠকও করেন। আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) বলেন, “পুলিশ সংযত আচরণ করেছে। পুলিশকে বলা হয়েছে, দোষীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে। নিরীহের উপরে যাতে অত্যাচার না-হয়, তা খেয়ালে রাখতে।”
জেলাশাসক বলেন, “স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানানো হয়েছে।” |